বগুড়া-৬ (সদর) আসনের উপনির্বাচনে ছয় ইউনিয়নে কেন্দ্র দখল ও ভোট ডাকাতি করে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বিজয়ী করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং বগুড়া শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মান্নান আকন্দ।
আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ হিসেবে পরিচিত মান্নান আকন্দ গতকাল রোববার রাতে ফেসবুক লাইভে এসে জেলার কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে অন্য নির্বাচনী এলাকা থেকে ভাড়াটে মাস্তান নিয়ে এসে ভোট ডাকাতির ওই প্রস্তুতির অভিযোগ তোলেন। ভোট ডাকাতি ঠেকাতে নির্বাচনী এলাকায় বহিরাগতদের আনাগোনা বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি প্রশাসনের কাছে দাবি জানান।
এদিকে ভোটারেরা মনে করছেন, এ উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মান্নান আকন্দের সঙ্গে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত নৌকার প্রার্থী রাগেবুল আহসানের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।
মান্নান আকন্দের ফেসবুক লাইভ নিজের পেজ ছাড়াও তাঁর শুকরা টিভিতেও (আইপিটিভি) প্রচার করা হয়। লাইভে মান্নান আকন্দ বলেন, ভোটের দিনে অন্য উপজেলার লোকজনের নির্বাচনী এলাকায় কী কাজ? প্রশাসনের উদ্দেশে বলেন, আপনারা মাইকিং করে ঘোষণা করেন, অন্য উপজেলার কাউকে নির্বাচনী এলাকায় দেখলে গ্রেপ্তার ও জেল-জরিমানা করা হবে। শুধু ছয়টা ইউনিয়নে এটুকু কাজ করেন। উপনির্বাচন অত্যন্ত স্বচ্ছ হবে।
ভোটারদের উদ্দেশে মান্নান আকন্দ বলেন, কোন ভোটকেন্দ্রে গন্ডগোল দেখলে পুলিশকে জানাবেন। কেউ গন্ডগোলে জড়াবেন না। কাউকে না পেলে প্রয়োজনে ৯৯৯ এ ফোন দিবেন। জয় পরাজয় একই মায়ের গর্ভে দুটি যমজ সন্তান। পরাজয় হলেও খুশি, জয় হলেও খুশি। আমি চাই ভোটারের নিরাপত্তা।
ডিসি ও এসপিদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে মান্নান আকন্দ বলেন, ভোটকেন্দ্র এলাকায় বহিরাগত ঠেকান। অন্য উপজেলার লোকজন জেনো নির্বাচনী এলাকায় দেখা না যায়। নির্বাচনে বিএনপি নেই। স্বাধীনতার প্রতীক নৌকা। বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ। সেই দল যদি ভোট চুরির চেষ্টা করে। তবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব জনগণের কাছে নিন্দিত হবে।
লাইভে এসে মান্নান আকন্দ অভিযোগ, নৌকার প্রার্থী রাগেবুল আহসানের নিজ এলাকা বগুড়া সদর উপজেলার নামুজা ইউনিয়ন। সেই নামুজা ও গোকুল ইউনিয়নে কেন্দ্র দখল, ভোট বন্ধ এবং নৌকাবিরোধী ভোটারদের বাধা দিয়ে নৌকা জেতাতে দায়িত্ব নিয়েছেন শিবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র এবং শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুর রহমান। শিবগঞ্জ, বিহার, গোবিন্দগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩০ লাখ টাকা ঢেলে তিনি ৬০০ মাস্তান ও গুন্ডা ভাড়া করেছেন। এসব লোকজন দিয়ে পুরো পুরো কেন্দ্র দখল নেওয়া হবে। এসব মাস্তান দিয়ে যাঁরা শুধু আওয়ামী লীগ করে, তাঁদের ভোটকেন্দ্রে আসতে দেওয়া হবে; রাস্তাঘাটে নৌকাবিরোধী ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে বাধা, ইভিএম-এ প্রকাশ্যে নৌকায় ভোট নেওয়াসহ নানা কৌশল নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মেয়র তৌহিদুর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের নির্দেশ দিয়েছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী মান্নান আকন্দও যদি কেন্দ্রে যায় তবে তাঁকে মেরে ফেল।
তবে মেয়র তৌহিদুর বলেন, বগুড়ার এই উপনির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নৌকার প্রার্থী হয়েছেন। তাঁর পক্ষে ভোট চাওয়া তো দোষের কিছু নয়। প্রচারণা শেষ, আমাদের কাজও শেষ। ভোটের দিনে কেন্দ্র দখল বা ভোট ডাকাতির অভিযোগ ভিত্তিহীন।
মান্নান আকন্দ ফেসবুক লাইভে আরও বলেন, বগুড়া সদরের লাহিড়ীপাড়া ইউনিয়নে ভোটকেন্দ্র দখলের দায়িত্ব নিয়েছেন বগুড়া শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং গাবতলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রফি নেওয়াজ খান। তিনি গাবতলী থেকে লোক এনে নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করার দায়িত্ব নিয়েছেন।
মান্নান আকন্দ অভিযোগ করেন, শেখেরকোলা ইউনিয়নে কেন্দ্র দখলের দায়িত্ব নিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও নামুজা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ শহিদুল ইসলাম। তাঁকে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করছেন ধুনট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুহম্মদ আসিফ ইকবাল। তিনি বগুড়া-৫ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য হাবিবর রহমানের ছেলে।
তবে আসিফ ইকবাল বলেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করতে একটি নির্বাচনী কমিটি করেছেন। সেখানে শেখেরকোলা ইউনিয়নে নৌকার প্রচারণা কমিটিতে আমাকে রাখা হয়েছে। দুই থেকে তিন দিন প্রচারণায় অংশও নিয়েছি। কিন্তু সেখানে ভোট ডাকাতি করতে অর্থ লগ্নি বা পেশিশক্তি প্রদর্শনের কোনো ভিত্তি নেই।
শহিদুল ইসলাম বলেন, আমি কলেজে শিক্ষকতা করি। দলীয় ক্যাডার নই। আবদুল মান্নান ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলেছেন।
ফেসবুক লাইভে মান্নান আকন্দ আরও অভিযোগ করে বলেন, শাখারিয়া ইউনিয়নে কেন্দ্র দখল করে নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করার দায়িত্ব নিয়েছেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবু সুফিয়ান। তিনি দলীয় লোক ভাড়া করে আনছেন সোনাতলা উপজেলা থেকে। তবে আবু সুফিয়ান বলেন, ইভিএমএ ভোট হবে। সেখানে কারচুপির কোনো সুযোগ নেই।
মান্নান আকন্দ বলেন, রাজাপুর ইউনিয়নে কেন্দ্র দখলের দায়িত্ব নিয়েছেন সরকারি আজিজুল হক কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক এবং জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য কামরুল হুদা। তিনি নিজ এলাকার দলীয় লোকজন নিয়ে ভোট ডাকাতির পরিকল্পনা এঁটেছেন। তবে এ ব্যাপারে কামরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, মান্নান আকন্দ নেতাদের হেয় করতেই ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলেছেন। সবই তাঁর স্ট্যান্ডবাজি। কিসের ভিত্তিত্তে তিনি বলছেন, ছয় ইউনিয়নে ভোট ডাকাতি হবে? তার কাছে কী তথ্য–প্রমাণ আছে। প্রমাণ থাকলে তা প্রকাশ করুক।
কী তথ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে লাইভে এসে ছয় ইউনিয়নে ভোট ডাকাতির চেষ্টার অভিযোগ তুললেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে মান্নান আকন্দ বলেন, নির্বাচনে অর্থ খরচ করে আমি নিজস্ব গোয়েন্দা দল নিয়োগ করেছি। নৌকার পক্ষের নেতা–কর্মীরা কখন কোথায় কী পরিকল্পনা করছেন—সব তথ্য প্রমাণই আমার কাছে আছে। ভোট ডাকাতির নীলনকশার অভিযোগ ভিত্তিহীন নয়, স্বচ্ছ কাচের মতো সত্য। ওই ছয় ইউনিয়নে ভোটের দিনে বহিরাগতদের ঠেকাতে প্রশাসন উদ্যোগ নিলেই কেন্দ্র দখল করে ভোট ডাকাতির ষড়যন্ত্র ভেস্তে যাবে।
মান্নান আকন্দ বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন করতে ব্যর্থ হলে, রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি থাকলে দায় রাষ্ট্র তথা নির্বাচন কমিশনকেই নিতে হবে।
জানতে চাইলে বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী বলেন, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে বহিরাগতদের নিয়ে এসে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন সৃষ্টির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।