বগুড়ার মহাস্থান হাট

‘ধলতা’ ও ‘খাজনায়’ লাভ টেকে না সবজিচাষিদের

বগুড়ার মহাস্থান হাট
ছবি: প্রথম আলো

দেশে সবজির অন্যতম বড় মোকাম বগুড়ার মহাস্থান হাটে উৎপাদিত সবজি বিক্রি করতে এসে প্রতি মণে চার কেজি বেশি সবজি দিতে হয় চাষিদের। এর মধ্যে দুই কেজি ‘ধলতা’ এবং দুই কেজি হাটের ‘খাজনা’ হিসেবে দিতে হয়। সেই হিসাবে হাটে ১০ মণ সবজি বিক্রি করতে এসে চাষিরা দাম পান ৯ মণের।

যদিও ক্রেতার কাছ থেকে হাটের খাজনা আদায়ের নিয়ম থাকলেও ইজারাদারের লোকজন জবরদস্তি করে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের কাছ থেকেই খাজনা তুলছেন। অন্যদিকে ওজনের বেশি পণ্য নেওয়া অনিয়ম হলেও কৃষকদের জিম্মি করে ধলতা আদায় এখন ‘নিয়মে’ পরিণত হয়েছে।

সবজিচাষিদের অভিযোগ, বছরের পর বছর তাঁরা প্রতারিত হলেও ধলতা ও খাজনা বন্ধে প্রশাসনের কোনো তৎপরতা নেই।

হাটে সবজি বিক্রি করতে আসা চাষিদের প্রতি মণে দুই কেজি সবজি বেশি দিতে হয় আড়তদার ও ব্যাপারীদের। বেশি দেওয়া এই সবজি স্থানীয়ভাবে ‘ধলতা’ নামে পরিচিত। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বুরুজ গ্রামের চাষি মহিদুল ইসলাম বুধবার মহাস্থান হাটে খেতের ১০ মণ মুলা বিক্রি করেন এক ব্যাপারীর কাছে। প্রতি মণ মুলার দর ঠিক হয় এক হাজার টাকা।

সেই হিসাবে ১০ মণ মুলার দাম পাওয়ার কথা ১০ হাজার টাকা। ব্যাপারী তাঁর হাতে ৯ হাজার টাকা তুলে দেন। মহিদুল বলেন, ‘১০ মণ মুলা হাটত লিয়ে আসনু, এক মণই ফাও। ২০ কেজি ধলতা লিচ্চে ব্যাপারী। হাটের খাজনা ২০ কেজি।’

কাঁচা সবজি পচনশীল হওয়ায় ৮-১০ বছর ধরে এ হাটে সব ধরনের সবজিতে মণপ্রতি দুই কেজি করে ধলতা নেওয়ার নিয়ম চালু আছে। এতে ব্যাপারীদের কোনো লাভ নেই। এক হাজার কেজি সবজি কিনলে আড়তদার-ব্যবসায়ীদের ৫০ কেজি সবজি ধলতা দিতে হয়।
মোহাস্মদ নুরন্নবী, হাটের ব্যাপারী
মহাস্থান হাটে সবজির বিপুল আমদানি রয়েছে

বুধবার মহাস্থান হাটে আসা চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শরৎকালে শীতের সবজি ফলাতে বেশ বেগ পেতে হয় কৃষককে। শীত মৌসুমের কয়েক মাস আগেই বগুড়ার বাজার ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, মুলা, পালংশাক, গাজরের মতো সবজিতে ঠাসা। অসময়েও হাটে সবজির বিপুল আমদানি। সাতসকাল থেকে হাটে বস্তাভর্তি কাঁচা মরিচ, পটোল, ঝিঙে, বেগুন, ঢ্যাঁড়স, কচুমুখি, কাঁকরোল, শসা, করলা, পেঁপে সাজিয়ে সারিবদ্ধভাবে বসেছেন চাষিরা।

কেউ কেউ ভ্যান-ভটভটিতেই থরে থরে মুলা, ছাঁচি লাউ, জালি কুমড়াসহ নানা সবজি সাজিয়ে বিক্রির জন্য হাটে তুলেছেন। হাটে বিপুল সবজির আমদানি। সবজি বিক্রি করতে আসা চাষিদের কাছ থেকে ইজারাদারের লোকজন মণপ্রতি দুই কেজি করে খাজনা তুলছেন। অন্যদিকে দরদাম ঠিক হওয়ার পর ব্যাপারী ও আড়তদারেরা মণপ্রতি দুই কেজি করে ধলতা নিচ্ছেন।

চাষিরা বলেন, ৪০ কেজিতে মণ হলেও কোনো কোনো সবজিচাষি হাটের নিয়ম মেনে আগে থেকেই প্রতি মণে ৪৪ কেজি বিক্রির জন্য এনেছেন। হাটে নতুন আসা বা নিয়ম না জানা বিক্রেতার সঙ্গে ব্যাপারীদের বাগ্‌বিতণ্ডার দৃশ্যও দেখা গেছে।

১২ মণ করলা বিক্রির জন্য এসেছিলেন জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার মোলামগাড়ির কৃষক আফাজ উদ্দিন। প্রতি মণ ১ হাজার ৮০০ টাকা দরে করলা বিক্রি করেন তিনি। কিন্তু দরদাম ঠিক হওয়ার পর আড়তে সবজি খালাস শেষে ২৪ কেজি সবজির দাম কম দেওয়া হলে আড়তদারের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। শেষে রাগে গজগজ করতে করতে হাট ছাড়েন তিনি।

মহাস্থান হাটের ইজারাদার বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান। ইজারাদারের পক্ষে হাটে টোল আদায় ব্যবস্থাপনা তদারক করছেন শাহ আলম। তিনি বিক্রেতাদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, চাষিদের কাছ থেকে খাজনা বা তোলা আদায়ের অভিযোগ ঠিক নয়।

হাটের ব্যাপারী মোহাস্মদ নুরন্নবী প্রথম আলোকে বলেন, কাঁচা সবজি পচনশীল হওয়ায় ৮-১০ বছর ধরে এ হাটে সব ধরনের সবজিতে মণপ্রতি দুই কেজি করে ধলতা নেওয়ার নিয়ম চালু আছে। এতে ব্যাপারীদের কোনো লাভ নেই। এক হাজার কেজি সবজি কিনলে আড়তদার-ব্যবসায়ীদের ৫০ কেজি সবজি ধলতা দিতে হয়।

মহাস্থান হাট সবজি, কাঁচা ও পাকা মাল ব্যবসায়ী এবং আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আড়ত থেকে পাইকারি মোকামে সবজি পরিবহনের সময় কিছু সবজি পচে যায়। কিছু নষ্ট হয়। এ কারণে হাটে সবজি বিক্রি করতে আসা চাষিদের কাছ থেকে প্রতি মণে দুই কেজি ধলতা তোলা হয়। চাষিরা এটা নিয়ে কখনো আপত্তিও করেন না। ধলতা তোলার নিয়ম বন্ধ হলে ব্যবসায়ীরা মণপ্রতি দুই কেজি সবজি নষ্ট হিসাব করেই চাষিদের কাছ থেকে সেই মূল্য কম দিয়ে সবজি কিনবেন।