বাড়ির পাশে শাকবাড়িয়া নদী থেকে হাঁড়িতে ভরে লোনাপানি নিয়ে নদীর বেড়িবাঁধের ঢাল বেয়ে উঠছিলেন সুফিয়া খাতুন। এই পানি কী কাজে লাগবে জানতে চাইলে সুফিয়া বলেন, ‘এই নোনাপানিতেই ঘর–গেরস্থালির কাজ সারি, গা ধোবার (গোসল) জন্যিও লাগে। বাড়ির পুকুরির পানির যে অবস্থা, তাতে হাত ধোবারও কায়দা নেই। বাধ্য হয়ে গাঙের নোনাপানি দিয়েই সব কাজ সারতি হয়।’
সুফিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ওই এলাকার জমিতে লোনাপানির চিংড়ি চাষের কারণে সবখানে লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়ির পুকুর ও ডোবায় দীর্ঘদিনের বদ্ধ পানিতে নামলে শরীরে দেখা দেয় নানা উপসর্গ। যে কারণে নদীর পানিতেই ভরসা তাঁদের। তবে খাওয়ার পানি দূরের পুকুর থেকে এনে খেতে হয়।
এমন অবস্থা খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রার সুন্দরবন–সংলগ্ন নদীতীরবর্তী গ্রামগুলোতে। সেখানে গভীর ও অগভীর নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আয়রন ও লবণাক্ত হওয়ায় সেগুলোর বেশির ভাগ অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। লোনাপানির চিংড়িঘেরের কারণে অধিকাংশ পুকুরের পানি এখন ব্যবহার অনুপযোগী।
সম্প্রতি কয়রার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের শেখেরকোনা, মহারাজপুর ইউনিয়নের মঠবাড়ি ও কয়রা সদর ইউনিয়নের সোনাপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ নারী নদীর পানিতে গোসল ও ঘর–গৃহস্থালির কাজ সারছেন। সেখানে বাঁধের পাশে আছে সারি সারি ঝুলন্ত টয়লেট। নেট দিয়ে ছেঁকে সে পানি কলসিতে ভরে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। ওই পানিতেই বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েদের গোসলসহ চলবে ঘর-গৃহস্থালির যাবতীয় কাজ। আশপাশের জমিতে লোনাপানির চিংড়িঘের থাকায় পুকুরের পানিও লবণাক্ত। তা ছাড়া গ্রামগুলোর দু-তিন কিলোমিটারের কোথাও নলকূপ নেই।
কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা জানালেন, পানি সংগ্রহ করার দায়িত্ব নারীদের। খাওয়ার পানির জন্য এলাকার নারীরা প্রতিদিন দূরের মিঠাপানির পুকুর থেকে কলসি ভরে পানি নিয়ে আসেন। এতে খাওয়ার পানির সমস্যা একরকম মিটলেও দূষিত পানি ব্যবহারে চর্মরোগের প্রকোপ রয়েছে।
মহেশ্বরীপুর গ্রামের সুষমা রানী মণ্ডল বলেন, বর্ষাকালে নদীর পানির লবণাক্ততা কিছুটা কমে। শুষ্ক মৌসুমে এসে পানির লবণাক্ততা এত বেশি বাড়ে, তা মুখে দেওয়া যায় না। তবু গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে তাঁরা এ পানিতেই যাবতীয় কর্ম সারছেন।
গ্রামের স্কুলপড়ুয়া মেয়ে ফারিহা খাতুন আক্ষেপ করে বলে, ‘নোনাপানির কারণে আমাগে গায়ের রং কালো হয়ে যায়। এইহানে বাতাসেও নোনা ভাইসে বেড়ায়। যে কারণে আমাগের চেহারাও ভালো হবার জো নেই।’
ফারিহার কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে পাশে দাঁড়ানো নিলুফা খাতুন নামের এক নারী বলেন, ‘মেয়েরা সাবালক (বয়ঃসন্ধি) হলেই বিয়ে দিতে হয়। একটু বয়স বাড়লেই নোনাপানিতে চেহারা কালো হয়ে যায়। দূরের আত্মীয়স্বজন কেউ বেড়াতে আসতি চায় না। এখানে আসলি গোসল করতি পারে না। খাবার পানিও মাইপে খাতি হয়। কেউ একবার আসলি ফের আসার নাম করে না।’
কপোতাক্ষ নদের পাড়ের গাজিপাড়া গ্রামের গৃহিণী বিউটি বেগম বলেন, ‘পানির কারণে নানা সমস্যায় ভুগতি হয় আমাগের। বাচ্চাদেরও অসুবিধা হয়। অসুখ-বিসুখ হলি পাসের দোকান থেকেই বড়ি কিনে খাই।’ ওই গ্রামসহ আশপাশের অন্তত ১০ গ্রামের কোথাও চিকিৎসক বা চিকিৎসাকেন্দ্র নেই বলে জানান তিনি।
কয়রার সুন্দরবন–সংলগ্ন কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, নদীতে অনেক নারী পিঠে দড়ি বেঁধে জাল টানছেন। সুন্দরবনের গহিনের নদী থেকে উজানে ভেসে আসা বাগদার পোনা ধরার জন্য অসংখ্য নারী জাল পেতে রেখেছেন নদীতে। লোকালয়ের কাছে ছোট–বড় নদীতে কেউ টানা জালের সাহায্যে, কেউ নৌকায় বসে জাল পেতে মাঝনদীতে অপেক্ষা করছেন। রেণু আহরণের জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করেন তাঁরা।
কয়রা গ্রামের স্বাস্থ্যকর্মী ফরিদা খাতুন বলেন, প্রতিদিন উপকূলীয় অঞ্চলের নারীরা চিংড়ির পোনা ধরার জন্য ৭-৮ ঘণ্টা নদীর লবণাক্ত পানিতে থাকেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বেড়েছে। মাত্রাতিরিক্ত এসব লোনাপানির দৈনন্দিন ব্যবহারের ফলে জরায়ু-সংক্রান্ত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন নারীরা।
সুন্দরবন–সংলগ্ন উপকূলীয় কয়রা উপজেলার নারী ও কিশোরীদের নিয়ে কাজ করছে কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (সিডিও) নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ২০২২ সালে সংগঠনটির একটি জরিপে দেখা গেছে, কয়রা উপজেলার প্রায় ৯৫ শতাংশ নারী ও ৭০ শতাংশ কিশোরী স্বাস্থ্য সুরক্ষার আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। তাঁরা এখনো ঋতুস্রাবের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিনের বদলে কাপড় ব্যবহার করেন। কিশোরীদের মধ্যে স্যানিটারি প্যাডের প্রচলন হলেও নারীদের মধ্যে এ প্রচলন খুবই কম।
কয়রার আংটিহারা কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) সাধন কুমার বলেন, এখানকার অধিকাংশ নারী নদী ও লোনাপানির ঘের থেকে মাছ ও কাঁকড়া আহরণ করেন। ক্লিনিকে প্রতিদিন পর্যাপ্ত চর্মরোগী সেবা নিতে আসেন। এ ছাড়া জরায়ুর সমস্যাসহ নানা রোগে আক্রান্ত নারী রোগীর সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, বছরজুড়ে চিকিৎসা নিতে আসা উপকূলের নারীদের অধিকাংশের সমস্যা জরায়ু, ডিম্বনালি ও অন্যান্য প্রজনন অঙ্গের। এর অন্যতম কারণ মাটি ও পানিতে সহনশীল মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি লবণ। লবণাক্ততার সঙ্গে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস, সচেতনতার অভাব এবং অপুষ্টি এই সংক্রমণের অন্যতম কারণ।