চট্টগ্রামের লোহাগাড়া ও সাতকানিয়ার বড় হাতিয়ার বনের ছড়ার বাঁধ কেটে দখলমুক্ত করা হয়েছে আট মাস আগে। পানি সরে যাওয়ার পর সেই বনে এখন প্রাকৃতিক ঘাস ও নানা গুল্প জন্মেছে। পুরো বনটি এখন সবুজে ঢাকা
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া ও সাতকানিয়ার বড় হাতিয়ার বনের ছড়ার বাঁধ কেটে দখলমুক্ত করা হয়েছে আট মাস আগে। পানি সরে যাওয়ার পর সেই বনে এখন প্রাকৃতিক ঘাস ও নানা গুল্প জন্মেছে। পুরো বনটি এখন সবুজে ঢাকা

বড় হাতিয়ার সেই বন এখন সবুজে ঢাকা, বন্য প্রাণীরা ফিরে পেয়েছে আবাসস্থল

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বড় হাতিয়া ও সাতকানিয়া উপজেলার সোনাকানিয়া সীমান্তবর্তী এলাকায় পাহাড়ি ছড়ায় বাঁধ দিয়ে কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট হ্রদটির পানি নেমে যাওয়ার পর আট মাস পার হয়েছে। বাঁধ কেটে দখলমুক্ত হওয়ার পর উন্মুক্ত সেই বনটিতে প্রাকৃতিক ঘাস জন্মেছে। পুরো বনটি এখন সবুজে ঢাকা।

সম্প্রতি বন এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ি ঝরনা থেকে সৃষ্ট সোনাকানিয়া ছড়াটি বনের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে। একাধিক পাহাড়ি ঝরনার স্বচ্ছ পানি কলকল শব্দে ছড়াটি দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সোনাকানিয়া ছড়ার স্বাভাবিক প্রবাহ যেন পুরো বনে প্রাণের সঞ্চার করেছে। ছড়ার দুই পাশের বিস্তীর্ণ বন নানান প্রাকৃতিক ঘাস, গুল্ম ও লতাপাতায় ভরে গেছে। বনের চারদিকে সবুজের সমারোহ। স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ বনের চারণভূমিতে গবাদিপশু চরাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বন থেকে শণ, ঝাড়ু ফুল ও মরা গাছের ডালপালা সংগ্রহ করছেন। বনের ছড়ার পানিতে কয়েকজনকে মাছ ধরতেও দেখা গেছে।

স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি বাঁধ কাটার পর ওই এলাকায় নিয়মিত হাতির দল বিচরণ করছে। বাঁধ দিয়ে কৃত্রিম হ্রদ সৃষ্টির ফলে বন পানিতে ডুবে যাওয়ায় দীর্ঘ চার বছর হাতির আবাসস্থল ও করিডর বন্ধ ছিল। তাই হাতির পাল স্থানীয় লোকজনের ঘরবাড়ি ও কৃষি খেতে হামলা করত। এতে স্থানীয় মানুষের জানমালের ক্ষতি হতো। এখন হাতি লোকালয়ে কম আসে। এতে হাতির আক্রমণে কৃষকদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কমে এসেছে।

বন বিভাগ বলছে, বনের ছড়ায় পানি চলাচলের ফলে ছড়ার দুই পাশে বনায়ন করা সহজ হবে। ছড়ার পানিতে কচ্ছপ, শামুক, কাঁকড়া ও প্রাকৃতিক মাছসহ বিভিন্ন জলজ জীববৈচিত্র্য জন্ম নেবে। এসব জলজ জীববৈচিত্র্য পাখি, সাপ ও বন্য প্রাণীদের খাদ্যের জোগান দেবে।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘চুনতি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য থেকে বাঁশখালী ইকোপার্ক পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার হাতির করিডর (চলাচলের পথ) ছিল। অবৈধভাবে বাঁধ নির্মাণ করে বিস্তীর্ণ বন ডুবিয়ে হ্রদ তৈরি করার পর করিডরের চার কিলোমিটার পানির নিচে তলিয়ে যায়। ফলে তিন বছর ধরে হাতি চলাচলের পথটি বন্ধ হয়ে যায়। বাঁধ কেটে দেওয়ার পর করিডরটি আবার সচল হয়েছে। তাই হাতির পাল তাদের পুরোনো জায়গায় নেমে এসেছে। হাতি চলাচলের পথটি এখন পুরোপুরি সচল হয়েছে। ওই পথ দিয়ে এখন নিয়মিত হাতি চলাচল করছে।

বড় হাতিয়া বনের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও পুনর্গঠনে বন অধিদপ্তরের গঠিত ৯ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটির অন্যতম সদস্য ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বনবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. জসীম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বন ডুবিয়ে হ্রদ সৃষ্টির ঘটনায় বনের জীববৈচিত্র্যের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বন পানির নিচে থাকার কারণে হাতি, শূকরসহ বন্য প্রাণীরা আবাসস্থল হারিয়েছে। ফলে বন্য প্রাণীরা আশপাশের বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি ও কৃষি খেতে আক্রমণ করেছে। এখন হাতি তার করিডরে ফেরত আসছে ও বনে ঘাস জন্মেছে। এগুলো খুবই ভালো খবর। এতে তাদের চলাচলের পথ উন্মুক্ত হচ্ছে। ফলে হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব কমে আসবে। তবে বন পুরোপুরি আগের অবস্থায় ফিরতে আরও অন্তত ১০ থেকে ১৫ বছর সময় লাগবে।

তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত বনকে দ্রুত আগের অবস্থায় ফেরাতে আমরা বেশ কিছু সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এসব সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ওই এলাকায় জনসাধারণের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বন বিভাগের নিয়মিত টহল বাড়াতে হবে। দ্রুত এলাকাটিতে বনায়ন করতে হবে। হাতি চলাচলের পথে হাতির খাদ্যের জোগান দেয়, এমন গাছ লাগাতে হবে।’

বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমিটির সুপারিশমতে এ বছর আগস্ট মাসে বড় হাতিয়া বনে আমরা ১০ হাজার ফলদ, বনজ ও ভেষজ গাছের চারা রোপণ করেছি। বৃক্ষরোপণের সময় বনের বেশির ভাগ এলাকা নরম ছিল। তাই বনের সব জায়গায় গাছ রোপণ করা সম্ভব হয়নি। আগামী বছর পুরো বনটি বৃক্ষরোপণের আওতায় আসবে। বনে নিয়মিত টহল জোরদারের জন্য আমাদের পর্যাপ্ত জনবল নেই। জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। সেটি সম্পন্ন হলে আমরা নজরদারি বাড়াতে পারব।’

এ বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে ‘বন ডুবিয়ে প্রভাবশালীদের হ্রদ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বাঁধ নির্মাণের সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম এবং বাঁধের কারণে বন, পাহাড় ও কৃষিজমির ক্ষতির চিত্র তুলে ধরা হয়।

এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার দিন বিকেলেই বাঁধ কাটার কাজ শুরু করে রাত সাড়ে নয়টার মধ্যে বাঁধটি পুরোপুরি অপসারণ করে বন বিভাগ। এরপর ওই দিন মধ্যরাতেই কৃত্রিম হ্রদের পানি নেমে যায়। যেখান থেকে পানি নেমে গেছে, সেখানে বন ধ্বংসের চিত্র উঠে আসে। বন বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, হ্রদ তৈরির কারণে গামারি, সেগুন, চিকরাশি, অর্জুনসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় প্রায় পাঁচ লাখ গাছ মারা গেছে। ডুবে যাওয়া জায়গার মধ্যে বন্য হাতির চলাচলের পথ ছিল। নানা প্রজাতির প্রাণী বাস করত সেখানে।