১৯৯২ থেকে ২০১০ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩৬ লাখ ৭৫ হাজার ৪০০ কেজি হাঙর, হাঙরের পাখনা, হাড়, ফুলকা ইত্যাদি রপ্তানি হয়েছে।
বন্য প্রাণী আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে হাঙর শিকার নিষিদ্ধ হলেও জেলেদের জালে নিয়মিতই ধরা পড়ছে বিপন্ন এই সামুদ্রিক মাছ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার উপকূলবর্তী এলাকায় প্রায়ই জেলেদের জালে হাঙর ধরা পড়ে। আর ঘাটে এনে এসব হাঙর বিক্রি করা হয় উচ্চমূল্যে। প্রক্রিয়াজাত করে হাঙরের শুঁটকিও বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে।
চট্টগ্রামের স্থানীয় জেলেরা জানান, প্রায়ই হাঙরের বাচ্চা ধরা পড়ে জালে। বাচ্চা হাঙরগুলো দিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে এই শুঁটকির চাহিদা ব্যাপক। এর পাশাপাশি হাঙরের পাখনা, চামড়া, দাঁত ইত্যাদি রপ্তানিও হয় দেশের বাইরে। চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের হাঙরের পাখনার স্যুপের জনপ্রিয়তা রয়েছে।
দেশে হাঙরের সুরক্ষার দায়িত্বটি বর্তমানে বন অধিদপ্তরের। আইন অনুযায়ী হাঙর শিকার ও বিক্রির অপরাধে শাস্তির বিধান রয়েছে। এ বিষয়ে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন সময়ে সচেতনতা কার্যক্রমের মাধ্যমে জেলেদের সচেতন করা হচ্ছে। তবে বাণিজ্যিক চাহিদা থাকায় কিছু ব্যক্তি হাঙর শিকার করছেন। ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি না হলে হাঙর সংরক্ষণ কঠিন হয়ে পড়বে।
দেশে প্রথমবারের মতো হাঙরের সুরক্ষার বিষয়টি উঠে আসে ২০১২ সালের বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে। সে সময় হাঙরের ১৮ প্রজাতিকে রক্ষিত প্রাণীর তালিকায় আনা হয়। তবে এরপরও থামানো যায়নি হাঙর ধরা।
২০২১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে হাঙরকে বিপন্ন প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন)। ওই বছর ২২ সেপ্টেম্বর আগের তফসিল সংশোধন করে মোট ২৮ প্রজাতির হাঙরকে সুরক্ষার তালিকায় আনা হয়।
তবে এরপরও বন্ধ হয়নি হাঙর শিকার। গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম নগরের নতুন ফিশারিঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রিকশায় করে দুটি আড়াই ফুট আকারের হাঙর পাশের পুরোনো ফিশারিঘাট এলাকায় বিক্রির উদ্দেশ্যে নিয়ে যাচ্ছেন এক বিক্রেতা। যদিও এ সময় বিস্তারিত কথা বলতে রাজি হননি মো. মুসলিম নামের ওই ব্যক্তি।
ফিশারিঘাট এলাকা থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বে নগরে শুঁটকি উৎপাদন কেন্দ্র বাস্তুহারা এলাকা। সরেজমিনে দেখা যায়, সেখানে নানা প্রজাতির মাছের পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে হাঙরের শুঁটকি। ছোট আকারের কয়েক হাজার হাঙর রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে শুঁটকি তৈরির জন্য।
আকার ভেদে ছোট আকারে হাঙর শুঁটকির দাম ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি। ব্যবসায়ীরা জানান, স্থানীয় বাজারে এই শুঁটকির চাহিদা কম। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই শুঁটকির চাহিদা রয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে সেখানেই পাঠানো হয় এই শুঁটকি। তবে কোন প্রজাতির হাঙর সুরক্ষিত, তা নিয়ে পর্যাপ্ত ধারণা নেই জেলে কিংবা ব্যবসায়ীদের।
চট্টগ্রাম ক্ষুদ্র শুঁটকি উৎপাদন-বিপণন সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হাশেম প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয়ভাবে ‘কালা হাঙর’ হিসেবে পরিচিত এই ছোট হাঙরগুলো। এসব হাঙরের শুঁটকির চাহিদা রয়েছে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে। দেশের পাশাপাশি দেশের বাইরেও রপ্তানি হয় হাঙরের শুঁটকি।
বাংলাদেশ রপ্তানি নীতির (২০২১-২৪) ধারা ১০ দশমিক ৪ ও বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের ২৯ ধারা অনুযায়ী সাইটিস সার্টিফিকেট এবং লাইসেন্স ব্যতীত বন্য প্রাণী আইনে থাকা প্রাণী রপ্তানি নিষিদ্ধ।
গত এক দশকে চট্টগ্রাম বন্দর ও টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মোট পাঁচটি চালান রপ্তানির তথ্য পাওয়া গেছে। এসব চালানে ২ হাজার ৩৬৭ কেজি হাঙরের চামড়া, পাখনা ও দাঁত রপ্তানি হয়েছে। রপ্তানি আয় এসেছে ৫ লাখ ৩১ হাজার টাকা সমমানের ডলার।
রপ্তানি চালানের তথ্যে দেখা যায়, সর্বশেষ ২০১৮ সালে ঢাকার মেসার্স প্যারাডাইস গ্লোবাল চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৬৬৪ কেজি ওজনের হাঙরের পাখনা রপ্তানি করেছে হংকংয়ে।
এর আগে চট্টগ্রাম বন্দর ও টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে হাঙরের চামড়া, হাড় ও দাঁত রপ্তানি করেছে চট্টগ্রাম নগরের রিয়াজউদ্দিন বাজারের জাফর এন্টারপ্রাইজ, পশ্চিম মাদারবাড়ীর দিলদার বেগম অ্যান্ড ব্রাদার্স, খাতুনগঞ্জের নেপচুন এন্টারপ্রাইজ ও সীতাকুণ্ডের এসএমএস ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল।
‘শার্ক ফিশারিজ স্ট্যাটাস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ্রোচ ইন দ্য বে অব বেঙ্গল, বাংলাদেশ’ শিরোনামে এক গবেষণায় বলা হয়, ১৯৯২ থেকে ২০১০ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩৬ লাখ ৭৫ হাজার ৪০০ কেজি হাঙর, হাঙরের পাখনা, হাড়, ফুলকা ইত্যাদি রপ্তানি হয়েছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এহসানুল করিম বলেন, কিছু প্রজাতির হাঙর বছরে ৭ থেকে ১৫টি বাচ্চা দেয়। এসব বাচ্চা প্রাপ্তবয়স্ক হতে ৩ থেকে ৪ বছর সময় লাগে। অতিরিক্ত হাঙর শিকার করলে তা অবশ্যই সমুদ্রের বাস্তুসংস্থানে প্রভাব ফেলবে।
গবেষকদের মতে, বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ উপকূলে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০টি কাছাকাছি হাঙরের প্রজাতি দেখা গেছে। তবে এর মধ্যে সব প্রজাতি বিপন্ন নয়। কোন প্রজাতি বিপন্ন এবং কোন প্রজাতির হাঙর ধরা যাবে—তা নিয়ে জেলেদের মধ্যে পর্যাপ্ত সচেতনতা নেই। এ জন্য জেলেদের সঙ্গে নিয়েই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণও দরকার।
বাংলাদেশি হাঙরের পাখনা দিয়ে তৈরি স্যুপের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে চীন, থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশে। এ ছাড়া দেশের বাজারে হাঙরের শুঁটকির চাহিদা রয়েছে। যার ফলে হাঙর শিকার বিক্রি ও রপ্তানি করা হচ্ছে। এর ফলে হাঙরের সংখ্যা কমছে বঙ্গোপসাগরে।
দীর্ঘদিন ধরে হাঙর ও বিপন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ নিয়ে কাজ করছেন ওয়াইল্ডটিমের বোর্ড সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আলিফা বিনতে হক।
আলিফা বিনতে হক প্রথম আলোকে বলেন, শুধু আইন প্রয়োগ করে হাঙর সংরক্ষণ সম্ভব নয়। এর জন্য পর্যাপ্ত গবেষণা, কারিগরি সহায়তা এবং মাঠপর্যায়ে আরও বেশি কার্যক্রম প্রয়োজন। কোন স্থানে বিপন্ন হাঙর প্রজাতিগুলো প্রজনন করে, চলাফেরা করে—এসব স্থান চিহ্নিত করে তা সম্পর্কে জেলেদের সচেতন করা উচিত।