ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ প্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে শহীদের ব্যবহৃত পাঞ্জাবি, লুঙ্গি এবং চেয়ার-টেবিল রয়েছে। ভাষাশহীদের সেসব স্মৃতিস্মারক দেখছে শিক্ষার্থীরা। গতকাল মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের রফিকনগরে
ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ প্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে শহীদের ব্যবহৃত পাঞ্জাবি, লুঙ্গি এবং চেয়ার-টেবিল রয়েছে। ভাষাশহীদের সেসব স্মৃতিস্মারক দেখছে শিক্ষার্থীরা। গতকাল মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের রফিকনগরে

বায়ান্নর কথা জানাচ্ছে শহীদ রফিকের পোশাক-আসবাব

ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদের স্মৃতিস্মারকগুলো জানান দিয়ে যাচ্ছে বায়ান্নর উত্তাল দিনগুলোর কথা।

ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে সুসজ্জিত আলমারিগুলোতে সাজানো বই। জাদুঘরের এক পাশে রাখা হয়েছে ভাষাশহীদের ব্যবহৃত পোশাক ও আসবাব। এসব স্মৃতিস্মারক জানান দিয়ে যাচ্ছে বায়ান্নর উত্তাল দিনগুলোর কথা।

ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদের আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধা জানাতে ১৫ বছর আগে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের রফিকনগরে তাঁর নামানুসারে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি নির্মাণ করা হয়। সারা বছর এটি এক প্রকার ফাঁকা পড়ে থাকলেও ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে কিছুটা হলেও বাড়ে দর্শনার্থীদের উপস্থিতি।

ভাষাশহীদ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন পাঁচজন—আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, রফিক উদ্দিন আহমদ, আবদুস সালাম ও শফিউর রহমান। ২০০০ সালে তাঁদের রাষ্ট্রীয় একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বরকত ও জব্বারের সঙ্গে নিহত হন রফিক। তিনি ছিলেন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে স্থানীয় নূর মহসিন বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মোহনা ইসলাম দেখতে এসেছিল রফিক উদ্দিনের স্মৃতিস্মারক। তার চোখে-মুখে কিছুটা ভাবগাম্ভীর্যের ছাপ দেখা গেল। মোহনা বলে, ‘মাঝেমধ্যে এখানে বই পড়তে আসতাম। এত দিন ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদের কোনো স্মৃতিচিহ্ন ছিল না জাদুঘরে। ভাষাশহীদকে দেখতে পারি নাই, কিন্তু জাদুঘরে তাঁর ব্যবহার করা পোশাক ও চেয়ার-টেবিল দেখতে তো পারছি।’

একই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র মো. ফাহিমের বাড়ি রফিকনগরে। সে বলে, ‘ভাষার জন্য রফিক উদ্দিন নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। ভাষাশহীদ রফিকের জন্ম যে গ্রামে, সেই রফিকনগরে আমারও জন্ম। আমার নিজের গর্ববোধ হয়।’

গতকাল দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, মহান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করা হয়েছে। ১৭টি আলমারিতে রাখা ১৬ হাজারের বেশি বই রয়েছে। এসব বই বের করে আবার গুছিয়ে আলমারিতে রাখা হচ্ছে। এদিকে ভাষাশহীদ রফিকের বাড়ির পাশে রফিক মঞ্চে শিশুশিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন চলছে। পাশে বসেছে গ্রামীণ মেলা।

মানিকগঞ্জ জেলা পরিষদ ও স্মৃতি জাদুঘর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ও জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে রফিক উদ্দিনের নিজ গ্রাম রফিকনগরে (পারিল) ৩২ শতক জমির ওপর গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি গড়ে তোলা হয়। শহীদ রফিকের প্রতিবেশী কর্নেল (অব.) মজিবুল ইসলাম খান জমিটি দেন। একই বছরের ১৫ মে এটি উদ্বোধন করেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

ভবনের সামনের দিকে দেয়ালে শহীদ রফিকের একটি ম্যুরাল ও ভেতরে দুটি ছবিই যেন জাদুঘরের নিদর্শন। জাদুঘরে কয়েকটি আলমারিতে রয়েছে বিভিন্ন বই। জাদুঘর থেকে ২৫০ থেকে ৩০০ গজ দূরেই শহীদ রফিকের পৈতৃক ভিটা। ২০০০ সালে প্রশিকা মানবিক উন্নয়নকেন্দ্র ওই বাড়িতে পাঠাগার ও বাসগৃহ নির্মাণ করে দেয়। সেখানে বসবাস করে শহীদ রফিকের ভাই মৃত আবদুল খালেকের পরিবার। বাড়িটির পাশে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। ১৫ বছর পর গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদ পরিবার রফিকের ব্যবহৃত লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, চারটি চেয়ার, একটি টেবিল ও একটি টেবিল ক্লথ জাদুঘরে দেয়। ২০০০ সালে পাওয়া রফিকের একুশে পদকের সম্মাননা স্মারকও রয়েছে।

গ্রন্থাগারের ও জাদুঘর দেখভালের দায়িত্বে আছেন ভাষাশহীদ রফিকের ভাতিজা মো. শাহজালাল। তিনি বলেন, প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত এলাকাবাসী এবং দর্শনার্থীদের জন্য গ্রন্থাগার ও জাদুঘরটি খোলা থাকে। এলাকার ছাত্রছাত্রীরা ভাষাশহীদের ব্যবহৃত পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, চেয়ার-টেবিল দেখতে আসে। দূর থেকে দর্শনার্থীরাও এখানে আসেন।

গ্রন্থাগার ও জাদুঘরটিতে কিছু সীমাবদ্ধতার কথাও জানালেন গ্রন্থাগারিক ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেন, গ্রন্থাগারে বাংলা একাডেমি থেকে দেওয়া প্রায় ১৬ হাজার বই রয়েছে। গ্রন্থাগারে চারটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা দেওয়া হতো। তবে পত্রিকার এজেন্ট মারা যাওয়ার পর প্রায় দুই বছর ধরে সেখানে কোনো পত্রিকা দেওয়া হয় না। নিজেদের সমস্যার কথাও জানালেন ফরহাদ। তিনি বলেন, গ্রন্থাগার ও জাদুঘরটি দেখভালকারী শাহজালাল এবং তাঁর নিজের চাকরি এখনো স্থায়ী হয়নি। এ ছাড়া তাঁদের বেতনও অপ্রতুল।

পাঁচ দিনব্যাপী অনুষ্ঠান

অমর একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ভাষাশহীদ রফিকের জন্মভিটার পাশে পাঁচ দিনব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ভাষাশহীদ রফিক মুক্তমঞ্চে চলছে শিশুশিক্ষার্থীদের গান, কবিতা আবৃত্তি, রচনা প্রতিযোগিতা, নৃত্যসহ নানা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। মঞ্চের পাশে বসেছে গ্রামীণ মেলাও। আজ বুধবার পর্যন্ত চলবে এসব অনুষ্ঠান ও মেলা।

অমর একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্‌যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ভাষাশহীদ রফিকের ভাতিজা আবদুর রউফ বলেন, এসব অনুষ্ঠান ও শিশুশিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে এসব অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে তাঁদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এ বিষয়ে সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।