জেলার রাজনীতি

নির্বাচনের আগে ফরিদপুর আওয়ামী লীগে কোন্দল চরমে, বিএনপিতেও বিভক্তি

নিয়ম রক্ষার দলীয় কর্মসূচি পালনের বাইরে প্রতিদ্বন্দ্বী দলীয় নেতাদের নামে বিষোদ্‌গার করেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা।

এ কে আজাদ ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী
এ কে আজাদ ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ফরিদপুরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও যুগ্ম সম্পাদকের নেতৃত্বে জেলা আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ মাঠে তৎপর রয়েছে। আরেকটি পক্ষ তৎপর রয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিপুল ঘোষের নেতৃত্বে। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও শহর আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ তাঁর পক্ষে কাজ করছে।

দ্বন্দ্ব, সংঘাত আছে জেলা ও মহানগর বিএনপির নেতাদের মধ্যেও। ২০২২ সালে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে জেলা বিএনপি। একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেলা কমিটির আহ্বায়ক সৈয়দ মোদাররেছ আলী ও সদস্যসচিব এ কে কিবরিয়া। অন্য অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুই যুগ্ম আহ্বায়ক আফজল হোসেন ও সৈয়দ জুলফিকার হোসেন। উপজেলার রাজনীতিতেও দ্বন্দ্ব-কোন্দল প্রকাশ্যেই চলছে।

আওয়ামী লীগে নতুন কমিটি, নতুন বিরোধ

দলীয় নেতারা জানান, ২০২২ সালে সর্বশেষ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়। সম্মেলনের আট মাস পর ৭৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়। সভাপতি শামীম হক, সাধারণ সম্পাদক শাহ্ মোহাম্মদ ইশতিয়াক ও যুগ্ম সম্পাদক অমিতাভ বোসের নেতৃত্বে ওই কমিটি চলছে। অন্য অংশে কেন্দ্রীয় নেতা বিপুল ঘোষের নেতৃত্বে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ফারুক হোসেন, মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভী মাসুদ, সাবেক সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহাসহ শহর আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ।

সূত্র জানায়, জেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধ শুরু হয়। ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবরের ওই নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ফারুক হোসেন। কিন্তু নির্বাচনে ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা-সদরপুর-চরভদ্রাসন) আসনের সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান ওরফে নিক্সন চৌধুরী সমর্থিত প্রার্থী শাহাদাৎ হোসেনের কাছে পরাজিত হন। ফারুকের অভিযোগ, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক চক্রান্ত করে তাঁকে হারিয়ে দিয়েছেন।

ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মনিরুল হাসান বলেন, সাবেক মন্ত্রী ও সদর আসনের সংসদ সদস্য খন্দকার মোশাররফ যেভাবে প্রভাব বিস্তার করে স্বৈরাচারী কায়দায় দল চালাতেন, বর্তমান নেতৃত্বও একই পথ অনুসরণ করছেন।

তবে দলীয় বিভক্তির বিষয়টি মানতে নারাজ শামীম হক। তিনি বলেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন বলে একটু সমস্যা হচ্ছে। এ সংকট থাকবে না। অভিযোগের বিষয়ে বলেন, তাঁর সন্ত্রাসী বা হেলমেট বাহিনী নেই। তিনি একক সিদ্ধান্ত নেন না। সবার মতামতের ভিত্তিতে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেন।

জেলা আওয়ামী লীগের এ বিভক্তি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন সদর আসনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এ কে আজাদ। তিনি বলেন, ফরিদপুর-৩ (সদর) আসন থেকে মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে তিনি পুরোপুরি আশাবাদী।

দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফরিদপুর-১ (মধুখালী-বোয়ালমারী-আলফাডাঙ্গা) আসনে দলীয় মনোনয়নের আশায় ডজনখানেক নেতা গণসংযোগ করছেন। এর মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্য ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সিরাজুল ইসলাম, মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত সিকদার, কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আরিফুর রহমান ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রউফের ছেলে আবদুল্লাহ আল মামুন অন্যতম। তাঁদের কারণে তিন উপজেলার রাজনীতিও বিভক্ত। ফরিদপুর-২ (নগরকান্দা-সালথা-সদরপুর) আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী সাতজনের নাম শোনা যায়। বর্তমান সংসদ সদস্য শাহদাব আকবর চৌধুরী ও নগরকান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জামাল হোসেনের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট। সালথা উপজেলা আওয়ামী লীগ আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চলছে। দ্বন্দ্বের জেরে নগরকান্দার সম্মেলন তিন দফা স্থগিত করা হয়েছে। ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হকের সঙ্গে আরেকটি অংশের দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান। ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা-চরভদ্রাসন-সদরপুর) আসনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান ওরফে নিক্সন চৌধুরীর মধ্যে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই আছে। নিক্সন চৌধুরী যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য।

শামীম হক ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী

জেলা আওয়ামী লীগের শামীম হক বলেন, ‘বিপুল ঘোষ কাদের নিয়ে গ্রুপিং করেন, ওখানে জেলা আওয়ামী লীগের কে আছেন। উনি (বিপুল ঘোষ) তো জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির একজন সদস্য মাত্র। ওনার সঙ্গে যারা আছে, তারা মোশাররফের উচ্ছিষ্টভোগী এবং টিআর–কাবিখার ভাগাভাগি উনিই করেন, পাশাপাশি জাতীয় পার্টি, জামায়াত সবাই আছে।’ সদর আসনে মনোনয়নের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘সব দিক থেকে আমি নিজেকে যোগ্য মনে করি। শতভাগ বলে কোনো কথা নেই, তবে আমি আশাবাদী।’

বিপুল ঘোষ বলেন, ‘কমিটি হয়েছে একতরফা। তাই জেলা আওয়ামী লীগে বিরোধ আছে এ কথা ঠিক না। এ কমিটি শামীম হকের লোক দিয়ে করা। এখানে বিভাজন করার ক্ষমতা আমার নেই। কমিটিতে এমন অনেককে পদ দেওয়া হয়েছে যাদের আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে ন্যূনতম সংযুক্তি ছিল না।’ তিনি আরও বলেন, শামীম হক খন্দকার মোশাররফের অংশীদার। খন্দকারকে যাঁরা ‘মিস গাইড’ করেছেন, উনি তাঁদের একজন।

বিএনপিতে নানা মত-পথ

নায়াব ইউসুফ মহিলা দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক

জেলা বিএনপির সর্বশেষ সম্মেলন হয় ২০০৯ সালে। ১০ বছর পর সেই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। ২০২২ সালে কেন্দ্র থেকে ৩১ সদস্যবিশিষ্ট জেলা ও মহানগর কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে জেলা বিএনপি। একটি অংশের নেতৃত্ব দেন আহ্বায়ক সৈয়দ মোদাররেছ আলী ও সদস্যসচিব এ কে কিবরিয়া। অপর অংশের নেতৃত্বে আছেন দুই যুগ্ম আহ্বায়ক আফজল হোসেন ও সৈয়দ জুলফিকার হোসেন। ৩ সেপ্টেম্বর তিন ভাগে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।

নেতা-কর্মীরা জানান, দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শহরের অলিতে-গলিতে বিলবোর্ড টাঙান যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আলমগীর কবির। তিনি সম্প্রতি কৃষক দলের আন্তর্জাতিক সম্পাদক হয়েছেন। তাঁর বিলবোর্ড টাঙানোর বিষয়টি ভালোভাবে নেননি সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের মেয়ে নায়াব ইউসুফ। তিনি আলাদা মিছিল করেন। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদের অংশ আফজাল হোসেন ও জুলফিকারের নেতৃত্বে আলাদা মিছিল করেন। আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবের মিছিলে যোগ দেন কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম (বাবুল)।

অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকার বিষয়টি মানতে নারাজ এ কে কিবরিয়া। তিনি বলেন, বিএনপি ঐক্যবদ্ধ। সবাই একসঙ্গেই আছেন। নির্বাচন নিয়ে অনেকে পোস্টার সাঁটাতে পারেন। সেটা নিয়ে ভীত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যুগ্ম আহ্বায়ক জুলফিকার হোসেন বলেন, সাংগঠনিকভাবে জেলা বিএনপি মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে আছে। উপজেলার কমিটি করতে গিয়ে নানা কেলেঙ্কারি সামনে এসেছে। এ জন্য নতুন চারটি কমিটি স্থগিত করেছে কেন্দ্র। সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব জরুরি হয়ে পড়েছে।

দলীয় সূত্র জানায়, ফরিদপুর-১ আসনে বিএনপির সাবেক দুই সংসদ সদস্য শাহ মো. আবু জাফর ও খন্দকার নাসরুল ইসলামের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট। নগরকান্দা ও সালথা বিএনপি শামা ওবায়েদ ও শহীদুল ইসলামের নেতৃত্বে দ্বিধাবিভক্ত। ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসনে বিএনপির সাংগঠনিক ভিত্তি তুলনামূলকভাবে দুর্বল। ভাঙ্গায় উপজেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার ইকবাল হোসেন ও জাসাসের কেন্দ্রীয় নেতা শাহরিয়ার ইসলাম শায়লার মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। শাহরিয়ার ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে অবস্থান করছেন। বর্তমানে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি জহিরুল হক।

শামা ওবায়েদ বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক

জেলা বিএনপির সদস্যসচিব এ কে কিবরিয়া প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি এখন আন্দোলনে আছে। দলের উদ্দেশ্য বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা। এ অবস্থায় উপজেলা সম্মেলন করার কোনো উদ্যোগ নেই।

শহীদুল ইসলাম বাবুল বলেন, বিএনপি একটি বড় দল। অনেকেই নেতা হতে চান, এমপি হতে চান এ নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে। তবে এ দ্বন্দ্ব সংঘাতের পর্যায়ে যায়নি। তিনি বলেন, ‘আমার সংসদীয় এলাকা ফরিদপুর-২। দল নির্বাচন করলে আমি ওই আসনে মনোনয়ন চাইব।’

কেন্দ্রীয় মহিলা দলের যুগ্ম সম্পাদক ফরিদপুর-৩ আসনের পাঁচবারের সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের মেয়ে নায়াব ইউসুফ বলেন, দ্বন্দ্ব মূলত বড় নেতাদের মধ্যে। তাঁরা ঠিক হলে ছোট ছোট নেতা ও কর্মীরাও ঠিক হয়ে যাবেন। দল নির্বাচন করলে তিনি দলীয় মনোনয়ন চাইবেন জানিয়ে নায়াব ইউসুফ বলেন, ‘আমি মনোনয়ন চাইব এবং আমি মনে করি দল সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে।’

শামা ওবায়েদ বলেন, জেলা বিএনপিতে তিনি বিরোধ দেখেন না। একটি বড় দলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকে, এটাকে দ্বন্দ্ব বলে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা হলে নির্বাচনে যাবে বিএনপি। তখন তিনি ফরিদপুর-২ আসন থেকে মনোনয়ন চাইবেন।