সাগরের তীরে শো শো বাতাসের মধ্যেও দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল বিলাপের ধ্বনি। কান্নাজড়িত আকুল কণ্ঠের ডাক, ‘ও পুত, পুতরে’ আর সবকিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছিল। আজ শনিবার বেলা ১১টার দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা উপকূলের স্লুইসগেট এলাকায় এভাবে চিৎকার করে ছেলেকে খুঁজতে দেখা গেল জেলেপাড়ার বাসিন্দা রাম দাশকে। ভোর থেকেই থেকে স্লুইসগেট থেকে জেটিঘাট পর্যন্ত ছুটোছুটি করছিলেন তিনি। কখনো ছেলেকে ডাকতে ডাকতে জ্ঞানও হারাচ্ছিলেন। কিন্তু যে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে তাঁর এই বুকভাঙা কান্না আর আর্তি, সেই সমুদ্র নিশ্চল-নিরুত্তরই রয়ে গেল।
কুমিরা জেলেপাড়ার বাসিন্দা রাম দাশের ছেলে আশু দাশ গত শুক্রবার ভোররাতে সাগরে গিয়ে নিখোঁজ হন। প্রায় ৩০ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও ছেলের খোঁজ নেই। ছেলের জন্য অস্থির হয়ে ওঠা রাম দাশ থানায় একটা ডায়েরি (জিডি) করেছেন আর আজ ভোর থেকেই সাগরের তীর ধরে ছেলের খোঁজে ছুটছেন। তাঁর সঙ্গে ছোট ছেলে বাসুদেব দাশ ও প্রতিবেশীরা থাকলেও কেউ শান্ত করতে পারছিল না। সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে ক্ষণে ক্ষণে চিৎকার করে তিনি বলছিলেন, ‘ও পুত তুই ফিরি আয়, তোর লাই আই মরি যায়ুমগইরে পুত।’ ছেলে না ফিরলে রাম দাশ বাঁচবেন না, এটা কথার কথা নয়। ছেলের শোকে এরই মধ্যে পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছেন তিনি। কখন ছেলে তাঁর জন্য কি এনেছে, সে কথাও ফিরে ফিরে বলছিলেন, কিছুদিন আগেই একজোড়া গামবুট এনেছিল আশু। বাবার পা কাদা থেকে রক্ষা করতেই বুটজোড়া কেনা। সে কথা মনে করে রাম দাশ বলছিলেন, ‘আঁর পুতে আঁর পা বাঁচাইবার লাই গামবুট লই আইচ্ছে। হেই পুত কডে গেল গই।’
আজ বেলা ১১টার দিকে কুমিরা উপকূলে গিয়ে দেখা যায়, ছোট ছেলে বাসুদেব দাশকে (১৩) জড়িয়ে ধরে বিলাপ করতে করতে মূর্ছা যাচ্ছেন রাম দাশ। পরে স্থানীয় লোকজন তাঁকে একটি দোকানে নিয়ে শুইয়ে দেন। স্থানীয় লোকজন নিখোঁজ আশুকে খুঁজতে নৌকা নিয়ে সাগরে রওনা হলে তিনি জোর করে নৌকায় উঠে ছেলেকে খুঁজতে চলে যান। ছেলের শোক কোনোভাবে তাঁকে শান্ত থাকতে দিচ্ছিল না।
আশু দাশের পরিবার সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় রুহি দাশের নৌকায় চাকরি করতেন আশু। ভোররাতের দিকে খালে যখন জোয়ারের পানি ঢুকছিল, তখন নৌকাটি জেটি এলাকায় নোঙর করতে নির্দেশ দেন রুহি দাশ। জেটিটি উপকূল থেকে সাগরের দিকে ৭০০ মিটার লম্বা। রেইনকোট পরে একাই নৌকা চালিয়ে জেটির মাথায় নিয়ে যান আশু দাশ। এরপর আর আশু ঘরে ফেরেননি। তাঁকে ফোন দিয়েও পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে তাঁরা জেটির মাথায় গিয়ে দেখতে পান নৌকাটি নেই। নৌকার মালিককে বিষয়টি জানানোর পর তাঁরা আরেকটি নৌকা নিয়ে আশুকে খুঁজতে বের হন। উভয় দিকে আট কিলোমিটার পথ খোঁজ করার পর সোনাইছড়ি ইউনিয়নের পাক্কা মসজিদ বরাবর সাগরে নৌকাটি নোঙর করা অবস্থায় পাওয়া যায়। এরপর ৩০ ঘণ্টা ধরে আশুর কোনো খোঁজ নেই।
সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আশু দাশ সাগরে নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে তার বাবা গতকাল শুক্রবার রাতে সীতাকুণ্ড থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। সাগরের বিষয়টি নৌ পুলিশ দেখাশোনা করছেন। নিখোঁজের পরিবারের সদস্যরাও খোঁজাখুঁজি করছেন।