ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার লস্করহাট গ্রামে একজন প্রসূতি মায়ের রক্তপাত হচ্ছিল। চারদিকে বন্যার থই থই পানির মধ্য দিয়ে কোনোভাবেই ওই মাকে হাসপাতালে নেওয়া যাচ্ছিল না। খবর পেয়ে তিনজন স্বেচ্ছাসেবক একটি স্পিডবোট নিয়ে ছুটে যান সে গ্রামে। তাঁরা ওই মাকে এবং তিন দিন আগে ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুকে উদ্ধার করে ফেনী শহরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করান। সঙ্গে ছিলেন ওই মায়ের একজন স্বজন। ভর্তির পর বন্যার কারণে ওই মায়ের দুর্গতির খবর জেনে একেবারে বিনা মূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
দেশের পূর্বাঞ্চলে হওয়া ভয়াবহ বন্যার মধ্যে ফেনীতে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করতে যাওয়া মমিনুর রহমান (প্লাবন) এ ঘটনার কথা জানিয়েছেন। মমিনুর ময়মনসিংহের একজন পরিচিত স্বেচ্ছাসেবী। ব্রহ্মপুত্র ব্লাড সোসাইটি গড়ে ময়মনসিংহে স্বেচ্ছা রক্তদানকে জনপ্রিয় করেছেন তিনি। গত ২২ আগস্ট রাতের বাসে ঢাকা থেকে ফেনীর উদ্দেশে রওনা হন মমিনুর রহমান ও তাঁর সঙ্গী আরও কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক। ২৩ আগস্ট সকাল থেকেই শুরু হয় দুর্গত মানুষের জন্য খাবার পৌঁছে দেওয়া এবং উদ্ধার করার কাজ।
মমিনুর রহমান ৯ দিনের স্বেচ্ছাসেবা শেষে গতকাল শনিবার ভোরে ময়মনসিংহে ফিরে আসেন। গতকাল দুপুরে তাঁর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। মমিনুর বলেন, ফেনীর বেশির ভাগ মানুষই আর্থিকভাবে সচ্ছল। ওই সব পরিবারে তেমন অভাব নেই। কিন্তু আচমকা বন্যার কারণে তাঁরা বিপাকে পড়ে গেছেন। তাঁরা কোনো প্রস্তুতির সুযোগ পাননি। সোনাগাজী, ছাগলনাইয়া, দাগনভূঞা, পরশুরাম উপজেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘোরেন মমিনুর। এসব এলাকা ঘুরে তিনি সেখানকার মানুষের আর্থিক অবস্থার একটি চিত্র পান। অনেকের বিলাসবহুল বাড়িও দেখেন মমিনুর। রাতারাতি বন্যার পানিতে ওই সব বাড়ির প্রথম তলা তলিয়ে যায়। গ্রামে গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, খাবার পানির জন্য মানুষের হাহাকার।
২৩ আগস্ট সকালে ফেনীর শহরের হাসপাতাল রোড এলাকা থেকে শুরু হয় নিজেদের স্বেচ্ছাসেবী কাজ শুরু করেন বলে জানান মমিনুর রহমান। শুরুতেই ধাক্কা খান তাঁরা। ধারণার চেয়ে অনেক বেশি পানির নিচে তলিয়ে ছিল ফেনী। নৌযান ছাড়া সেখানে যাওয়া যাচ্ছিল না। পরে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে তিনটি স্পিডবোট পান তাঁরা। প্রতিদিন সকাল থেকে বের হয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত তাঁরা মানুষের জন্য খাবার পানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নিয়ে যেতেন বলে জানান মমিনুর। গ্রাম থেকে ফেরার পথে অসুস্থ বা বৃদ্ধদের উদ্ধার করা আশ্রয়কেন্দ্রে বা হাসপাতালে নিয়ে যেতেন।
মমিনুর বলেন, কাজ শুরু করার তৃতীয় দিন দেখেন, পরশুরাম উপজেলার একটি গ্রামে বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়িতে আটকা পড়েছেন একটি পরিবারের সদস্যরা। সেদিন বাড়িতে গরুর মাংস রান্না হয়েছে। কিন্তু দ্রুত সময়ে বন্যা পানি বেড়ে যাওয়া ঘরে খাবার পানি ছিল না। যে কারণে কেউ ভাত খেতে পারছিলেন না। পরে খুব সংকোচে পানি চান তাঁরা। চতুর্থ দিন থেকে বেড়ে যায় মোম, কয়েল আর নারীদের ন্যাপকিনের চাহিদা। অনেকেই সংকোচ ভেঙে স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে স্যানিটারি ন্যাপকিন চান।
স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে ৯ দিন কাজ করার সময় ফেনীর মানুষের নৈতিকতাবোধ ও শৃঙ্খলাবোধ মমিনুর রহমানকে বিশেষভাবে আপ্লুত করেছে বলে তিনি জানান। তাঁর ভাষ্য, বিভিন্ন গ্রামে খাবারসহ অন্যান্য দ্রব্য দেওয়ার সময় দেখা গেছে, বেশির ভাগ মানুষই নিজের কাছে যে পণ্য পর্যাপ্ত আছে সেটি নেননি। এমনকি নিজেদের কাছে মজুত থাকা অতিরিক্ত পণ্য অন্যকে দেওয়ার জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে দিয়ে দেন অনেকেই। তবে শহর এলাকায় কিছু প্রতারকের দেখা পাওয়া যায়।
দাগনভূঞা উপজেলার একটি আশ্রয়কেন্দ্রে ৯০০ মানুষ আশ্রয় নেন বলে জানান মমিনুর। অল্প সময়ের জন্য সেখানে একটি কমিটি করা হয়। শিশুদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের ভেতর খেলাধুলার ব্যবস্থাও করা হয়। প্রতিবার রান্নার পর সুষ্ঠু বণ্টন হয়েছে সেখানে। এমনকি যেসব পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে পানি উপেক্ষা করে নিজেদের বাড়িতে থেকেছে তাঁদের জন্য পৌঁছে দেওয়া হয়েছে রান্না করা খাবার।
মমিনুর রহমান বলেন, ৯ দিন ফেনীর বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে থাকাটা জীবনের বড় একটা অর্জন। বিপদে মনোবল না হারিয়ে কীভাবে টিকে থাকা যায় সে শিক্ষা হয়েছে। ৯ দিন অনেক কষ্ট হয়েছে। কোনো রাতেই ঠিকমতো ঘুমানো যায়নি। দিনে শুকনা খাবার খেয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তাঁরা। কিন্তু এসব কিছুই মনে নেই। মনে আছে শুধু মানুষের ভালোবাসার কথা।