কেউ বেঞ্চে আবার কেউ মাটিতে মাদুরে বসে খাচ্ছেন সাত পুতি পিঠা। এক বৃদ্ধকে (৬৭) ওই পিঠা তৈরির পাশাপাশি পরিবেশন করতে দেখা যায়। মনে হচ্ছিল সেখানে পিঠা উৎসব চলছে। আদতে তা নয়। সেখানে বসে সাত পুতি পিঠা কিনে খাচ্ছিলেন লোকজন। এই চিত্র রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার ভবানীগঞ্জ হাটের।
ঐতিহ্যগতভাবে সাত পুতি পিঠা বাগমারা স্থানীয় মানুষের পছন্দের একটি খাবার। এখনো ঈদুল আজহার দিনে উপজেলার প্রতিটি ঘরে ঘরে মাংসের সঙ্গে সাত পুতি পিঠা খাওয়ার রেওয়াজ আছে। আর শীতে গুড় অথবা খেজুর রসের সঙ্গে মিশিয়ে ভিজিয়ে রেখে খাওয়া হয় এই পিঠা। সাত পুতি পিঠা খাওয়ার এই আয়োজন চলে ১২ মাসই।
উপজেলার ভবানীগঞ্জ পৌরসভার খাজাপাড়া (রামকৃষ্ণপুর) গ্রামের বাসিন্দা মোজাহার আলী সাত পুতি পিঠা বিক্রি করছেন ৪৬ বছর ধরে। তাঁকে দেখে একই গ্রামের আরও ১১টি পরিবার এসেছে এ পেশায়।
সম্প্রতি ভবানীগঞ্জ হাটে গিয়ে দেখা যায়, একটি চালার নিচে অস্থায়ী দোকানে পিঠা বিক্রি করছেন বৃদ্ধ মোজাহার আলী। তিনি উনুনে মাটির তৈরি সাত পুতির ফ্রেম (বিশেষ পাত্র) বসিয়ে পিঠা তৈরি করেছেন। ক্রেতাদের চাহিদামতো গরুর মাংস, হাঁসের মাংস ও মুরগির মাংসের তরকারি এবং শুকনা মরিচ, পেঁয়াজ ও শর্ষের তেল দিয়ে তৈরি চাটনির সঙ্গে সরবরাহ করছিলেন পিঠা। যাঁরা মাংস দিয়ে পিঠা খেতে চান না, তাঁদের জন্য পিঠার সঙ্গে বিনা মূল্যে চাটনি সরবরাহ করা হয়।
মোজাহার আলী জানান, তাঁর বাবা আগে পিঠা তৈরি করে বিক্রি করতেন। তিনি ২১ বছর বয়স থেকে শুরু করেছেন সাত পুতি পিঠা তৈরি ও বিক্রি। সেই পেশাতেই আছেন এখনো। আগে গ্রামে গ্রামে ঘুরে এই পিঠা বিক্রি করতেন তিনি।
মোজাহার আলী দাবি করেন, তিনিই প্রথম হাটবাজারে এই পিঠা বিক্রির প্রচলন শুরু করেন। তাঁর ভাষ্যমতে, হাট থেকে ধান কিনে তা শুকিয়ে, ঢেঁকিতে আটা করে পিঠা তৈরি করেছেন। স্ত্রী, কন্যারা এতে সহযোগিতা করতেন। এখন চালকলে আটা তৈরি শুরু হওয়ায় ঢেঁকির ঝামেলা কমেছে। ১০ বছর ধরে চালকলে আটা ভাঙানো হয়। তবে লোকজনের চাহিদামতো মাঝেমধ্যে ঢেঁকির আটায় সাত পুতি তৈরি করেন। কেননা, ঢেঁকি ছাঁটা আটার পিঠার স্বাদ আলাদা।
মোজাহার আলী বলেন, এই পেশায় নিজের ভাগ্যের উন্নয়ন করতে না পারলেও সংসারের অভাব তাড়িয়েছেন। ভালোভাবে চলতে পারেন। এই পেশায় থেকে একমাত্র মেয়েকে বিয়েও দিয়েছেন। দুই ছেলেকে সামান্য লেখাপড়া শেখানোর পর তাঁরা একই পেশায় আছেন। স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার চলে যাচ্ছে।
ওই গ্রামের বাসিন্দা ভবানীগঞ্জ মহিলা ডিগ্রি কলেজের বাংলার শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম বলেন, তাঁদের গ্রামের পুরোনো এবং প্রথম সাত পুতি ব্যবসায়ী মোজাহার আলী। তাঁকে অনুসরণ করে একই পাড়ার আরও ১১টি পরিবার এই পেশায় এসেছে।
মাজেদুর রহমানসহ তিনজন বিক্রেতা জানান, মোজাহার আলীকে অনুসরণ করে সাত পুতি পিঠা বিক্রি করেন তাঁরা। এলাকায় এই পিঠা বিক্রির প্রথম প্রচলন শুরু করেন তিনিই।
মোজাহার আলী বলেন, তাঁর এই পিঠার চাহিদা আছে। নিজ উপজেলা ছাড়াও আশপাশের এলাকা থেকে লোকজন এসে ভিড় করেন সাত পুতি পিঠা খেতে। অনেকে বাড়িতে নিয়ে যান। এক চাড় (সাতটি পিঠা) এখন বিক্রি করেন ১০ টাকায়। এর সঙ্গে চাটনি বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। এ ছাড়া এক বাটি গরুর মাংসসহ সাতটি পিঠা বিক্রি করেন দেড় শ টাকায়। তবে ঝোল ও এক টুকরা গরুর মাংসসহ সাতটি পিঠা বিক্রি করেন ৩০ টাকায়। এ ছাড়া ৭০-৮০ টাকায় বাটিভর্তি মুরগি ও হাঁসের মাংস দিয়ে খাওয়া যায় এই পিঠা। এখন চালসহ পিঠা তৈরির বিভিন্ন উপকরণ ও মাংসের দাম বাড়ার কারণে দাম বাড়াতে হয়েছে সামান্য। একসময় ১০-২০ টাকায় মাংসসহ পেট পুরে খাবার দেওয়া যেত। তবে এখন সম্ভব হয় না।
মোজাহার আলী আরও বলেন, বয়স বাড়ার কারণে দূরের হাটবাজারে যেতে পারেন না। একসময় পাশের উপজেলা দুর্গাপুর ও মোহনপুরের কয়েকটি হাটে অস্থায়ী দোকান বসিয়ে বিক্রি করলেও এখন পারেন না। এখন শুধু বাড়ির আশপাশের হাটবাজারে বিক্রি করেন। তাঁকে অনুসরণ করে দুই ছেলেও একই পেশায় এসেছেন। ছোট ছেলে জালাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বাবার বয়স হওয়ার কারণে তাঁকে সহযোগিতা করেন। আরেক ছেলেও একই কথা বলেছেন। বাবার পেশাতেই থাকার আগ্রহ তাঁদের।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধি যশোরের মনিরামপুরের বাসিন্দা আবু জাফর বলেন, সপ্তাহে তিন দিন তাঁকে ভবানীগঞ্জে আসতে হয়। ৫৫ টাকায় ১০টি সাত পুতি পিঠা ও দুই টুকরা গরুর মাংস দিয়ে দুপুরের খাবারটা এখানে সেরে নেন। এটা অনেক স্বাদের খাবার বলে মন্তব্য তাঁর।
ভবানীগঞ্জ হাটে আসা ট্রাকচালক আইনুল হক বলেন, তিনি এই হাটে সপ্তাহে দুই দিন কাঁচামাল কিনতে আসেন। কেনাকাটা শেষে তিনি সহকর্মীদের নিয়ে সাত পুতি পিঠা খান। তাঁদের এলাকায় এই পিঠা পাওয়া যায় না, তাই এখানে খেয়ে নেন।