দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগুড়ার তিনটি আসন থেকে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির সাবেক তিন নেতা। ইতিমধ্যে তাঁরা নির্বাচন কমিশন থেকে মনোনয়নপত্রও সংগ্রহ করেছেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) কিংবা তৃণমূল বিএনপি থেকে তাঁদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার গুঞ্জন শোনা গেলেও তাঁদের মধ্যে অন্তত দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন বলে প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন।
বগুড়া জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মাহমুদ হাসান ওই তিন নেতার মনোনয়নপত্র তোলার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তাঁরা হলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য ও আলোচিত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শোকরানা; সদর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সরকার বাদল এবং জেলা বিএনপির সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বিউটি বেগম।
মোহাম্মদ শোকরানা বগুড়া-১ আসন (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সরকার বাদল বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়তে মনোনয়নপত্র তুলেছেন। বিউটি বেগম বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসন থেকে নির্বাচন করবেন। গুঞ্জন উঠেছে, সরকার বাদল ও বিউটি বেগম বিএনএম থেকে নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন। যদিও সরকার বাদল ও মোহাম্মদ শোকরানা স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন বলে জানিয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে বগুড়া-১ আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছিলেন মোহাম্মদ শোকরানা। ২০১৯ সালের ৯ অক্টোবর বিএনপি থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন তিনি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত শোকরানা পদত্যাগপত্রে লিখেছিলেন, ‘ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে দলের সব পদ থেকে পদত্যাগ করলাম। এখন থেকে বিএনপির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’
সূত্র জানায়, যুবলীগের প্রতিষ্ঠাকালে বগুড়ার নেতৃত্বে থাকা শোকরানা ১৯৯৯ সালে তারেক রহমানের হাতে ফুল দিয়ে বিএনপিতে যোগ দেন। পরে তিনি জেলা বিএনপির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। শোকরানার বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বহুল আলোচিত ডাল কেলেঙ্কারি ও ত্রাণের কম্বল মজুত করার অভিযোগে মামলা হয়। একই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি যৌথ বাহিনী শোকরানার ১৫টি গুদাম থেকে সাড়ে ৫ মেট্রিক টন (১৮ হাজার বস্তা) মসুর ডাল ও বিপুল পরিমাণ ত্রাণের কম্বল জব্দ করে। ওই সময় তাঁকে গ্রেপ্তারও করা হয়। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আদালতে মামলাটির বিচারকাজ শুরু হলেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালের ২১ নভেম্বর সেই মামলা প্রত্যাহার করা হয়। আওয়ামী লীগের আমলে বিএনপির নেতার মামলা প্রত্যাহার নিয়ে এলাকায় নানা আলোচনা আছে।
মোহাম্মদ শোকরানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি যেহেতু নির্বাচনে আসছে না, আওয়ামী লীগ কোন দুঃখে নির্বাচনে কারচুপি করতে যাবে? ভোট স্বচ্ছই হবে।’ বিএনপি নির্বাচনে এলে কারচুপি হবে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হতেই পারে। তবে বিএনপি নির্বাচনে এলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হব না। বিএনপি থেকেই মনোনয়ন চাইব।’ আলোচিত মামলার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এটি ত্রাণের কম্বল ছিল না। দুস্থদের মধ্যে বিতরণের জন্য তারেক রহমান নিজ টাকায় কম্বল কিনে আমার গুদামে রেখেছিলেন। এ ছাড়া বিদেশ থেকে ১৬ কোটি টাকার ডাল আমদানি করে গুদামে রেখেছিলাম। যৌথ বাহিনী ভুল বুঝেই কম্বল ও ডাল জব্দ করে।’
সরকার বাদল নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বিএনপিতে যোগ দেন। ২০০৩ সালে তিনি সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি হন। পরে সদর উপজেলার কিছু অংশ নিয়ে শাজাহানপুর উপজেলা গঠিত হলে ২০১৪ সালে বিএনপির সমর্থনে শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে বগুড়া-৭ আসনে বিএনপির মনোনয়ন চেয়ে পাননি তিনি। সর্বশেষ ২০২২ সালে বগুড়া-৬ (সদর) আসনের উপনির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন।
সরকার বাদল প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করলেও কিছু নেতার কারণে তিনি দলে কোণঠাসা। বিএনপিতে ছিলেন, এখনো আছেন। তবে ভবিষ্যতে থাকবেন কি না, সময় বলে দেবে। বিএনএমের মনোনয়নে নির্বাচন করার বিষয়ে বলেন, ‘তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম থেকে নির্বাচন করার প্রস্তাব পেয়েছি। এখনো সিদ্ধান্ত নিইনি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
বিউটি বেগম জেলা বিএনপির মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ২০১৪ সালে দলের সমর্থনে তিনি শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হলে তাঁকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়।
বিউটি বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপাতত স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই নির্বাচনে লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অনেক দল থেকেই যোগাযোগ করা হচ্ছে, দেখা যাক, সময় বলে দেবে।’
জেলা বিএনপির সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান সরকারের অধীন কোনো প্রহসনের নির্বাচনে অংশ নেবে না বিএনপি। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নির্বাচনের তফসিল বাতিলের দাবিতে এক দফার আন্দোলন চলছে। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে যাঁরা মনোনয়নপত্র তুলেছেন বা ভবিষ্যতে তুলবেন, তাঁরা দলের কেউ নন; তাঁদের সঙ্গে দলের কোনো সম্পর্ক নেই।