বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত মহিউদ্দীন আহম্মেদকে নিয়ে বরিশাল-৪ আসনের (হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ) আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথের মন্তব্যে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সংসদ সদস্যের বক্তব্যকে কুরুচিপূর্ণ ও বিকৃত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ বলে উল্লেখ করেছেন অনেকে।
গত বুধবার দুপুরে মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়া বাজার এলাকায় একটি সভায় সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ প্রয়াত মহিউদ্দীন আহম্মেদের সমালোচনা করেন। পঙ্কজ নাথের দাবি, বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর ঢাকায় এমপি হোস্টেলে হাঁসের মাংস ও খিচুড়ি খেয়ে আমোদ-ফুর্তি করেছিলেন মহিউদ্দীন আহম্মেদ। আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য এর সাক্ষী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মহিউদ্দীন আহম্মেদের সহযোগীরা মেহেন্দীগঞ্জে ও বরিশালে বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুর করেছেন। এখন তাঁরাই মেহেন্দীগঞ্জে আওয়ামী লীগ করছেন।
দলের একজন সংসদ সদস্যের এমন বক্তব্য বরিশালে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের আঘাত করার শামিল বলে মনে করছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। তাঁদের দৃষ্টিতে মহিউদ্দীন আহম্মেদ একজন ত্যাগী, নির্লোভ, দেশপ্রেমিক নেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার নির্মমভাবে হত্যার পর তিনি ঝুঁকি নিয়ে সেই দুঃসময়ে বরিশালে দলকে সংগঠিত করেছিলেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি ২২–দলীয় জোটের সমন্বয়ক ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন।
পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনে মহিউদ্দীন আহম্মেদ একটি কানের শ্রবণশক্তি হারিয়েছিলেন, পাঁজরের হাড় ভেঙে গিয়েছিল তাঁর। এমনকি তাঁকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তিনি বেঁচে গেছেন। এমন একজন বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক নেতার বিষয়ে দলীয় মনোনয়নে নির্বাচিত সংসদ সদস্যের প্রকাশ্যে এমন মন্তব্য দলের নেতা-কর্মীদের অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে।
হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ বৃহস্পতিবার দুপুরে বলেন, প্রয়াত নেতা মহিউদ্দীন আহম্মেদ সম্পর্কে সংসদ সদস্য যা বলেছেন, এটা মনগড়া কাহিনি। তাঁর এ বক্তব্যের ফলে দলের নেতা-কর্মীরা বিক্ষুব্ধ। অচিরেই সভা আহ্বান করে এই বক্তব্যের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানো হবে।
মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামাল খান বলেন, ‘আমরা মিথ্যার জবাব কী দেব। এলাকায় সংসদ সদস্যের সঙ্গে দলের কোনো কর্মী নেই, জনগণ নেই। দলের সর্বস্তর থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এখন তিনি প্রলাপ বকছেন। আমরা দলীয় সভা-সমাবেশে এই মিথ্যা কল্পকাহিনির জবাব দেব।’
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মহিউদ্দীন আহম্মেদের মেয়ে শাম্মী আহম্মেদ বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। তাঁর বড় ছেলে সাহাব আহম্মেদ মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী শাম্মী আহম্মেদ। শাম্মী আহম্মেদ কয়েক দিন ধরে এলাকায় অবস্থান নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে সভা-সমাবেশ করছেন। তিনি বৃহস্পতিবার বিকেলেও হিজলা-গৌরবদী ইউনিয়নের একতা বাজারে একটি সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন।
গত সোমবার বিকেলে হিজলার কাউরিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে কর্মী সমাবেশ হয়। সেখানে হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ এবং সাংগঠনিক উপজেলা কাজীরহাটের আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা সংসদ সদস্য পঙ্কজের নানা সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। ১০ বছরে এলাকায় পঙ্কজ নাথ দলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর অন্যায়-অত্যাচার করায় আগামী নির্বাচনে এখানে শাম্মী আহম্মেদকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানান বক্তারা। ওই কর্মিসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন শাম্মী আহম্মেদ। তবে শাম্মী আহম্মেদ তাঁর বক্তব্যে সংসদ সদস্য পঙ্কজের কোনো সমালোচনা করেননি।
শাম্মী আহম্মেদের কর্মী সমাবেশের দুই দিন পর পঙ্কজ নাথ বুধবার তাঁর বাবাকে নিয়ে মন্তব্য করেন। পঙ্কজ নাথ বলেন, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মহিউদ্দীন আহম্মেদ। ক্ষমতা পেয়ে তিনি ওই সময় বরিশাল শহরে হিন্দু ও খ্রিষ্টানদের বাড়ি দখল করেছিলেন। ঢাকায় বাবর রোডে এক বিহারির বাড়ি দখল করেছিলেন। এ জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁকে ওই সময় গভর্নর করেননি।
এতে মহিউদ্দীন আহম্মেদ বঙ্গবন্ধুর ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন বলেও মন্তব্য করেন পঙ্কজ।
পঙ্কজ নাথের এমন বক্তব্যকে অনভিপ্রেত এবং দলীয় নীতি-আদর্শের বিরোধী বলে মন্তব্য করেছেন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, পঙ্কজ নাথ এমন বেফাঁস এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের জন্য দলের সর্বস্তরের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আলোচনায় আসতে এখন এসব অমূলক কথা বলে বেড়াচ্ছেন। তিনি যে দলের নীতি-আদর্শ ধারণ করেন না, এটা তারই প্রমাণ।
তবে নিজের বক্তব্যে এখনো অনড় পঙ্কজ নাথ। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এসব নিয়ে কেউ কথা বলে না। আমি বলছি বলেই অনেকের বিরাগভাজন হয়েছি। তবে সত্য বলা উচিত।’
শাম্মী আহম্মেদ আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁর (পঙ্কজ নাথের) এসব কথা জবাব দিতে আমাদের রুচিতে বাধে। কারণ, পারিবারিকভাবে আমরা এমন শিক্ষা পাইনি। আমার বাবা কী রকম ব্যক্তি ছিলেন, সেটা বরিশালের মানুষ জানেন। নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন নেই।’