খোলাবাজারে খাদ্যশস্য বিক্রয়কেন্দ্রে মানুষের ভিড়। গতকাল রোববার সকালে রংপুর নগরের দর্শনা এলাকায়
খোলাবাজারে খাদ্যশস্য বিক্রয়কেন্দ্রে মানুষের ভিড়। গতকাল রোববার সকালে রংপুর নগরের দর্শনা এলাকায়

‘সরকারোত যা–ই আসুক, হামরা কেমন করি বাঁচি আছি, খেয়াল করে না’

রংপুর নগরের ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নুরেজা বেগম (৪৫) সাতসকালে খাদ্য অধিদপ্তরের খোলাবাজারে খাদ্যশস্য বিক্রয়কেন্দ্রে (ওএমএস) এসেছেন। এখান থেকে চাল নিয়ে যাওয়ার পর তাঁর রান্না হবে। তিনি স্থানীয় মুদিদোকানে চাল কিনতে গিয়েছিলেন; কিন্তু বেশি দামের কারণে কিনতে পারেননি।

নুরেজা জানান, তাঁর চার ছেলেমেয়ে। তিনজনের বিয়ে হয়েছে। তাঁদের আলাদা সংসার। স্বামী, ছোট ছেলে ও পঙ্গু বোনকে নিয়ে তাঁর (নুরেজার) সংসার। স্বামী নলকূপের মিস্ত্রি। তবে কাজ পান এক-দুই সপ্তাহ পরপর। দিনমজুরি করে তাঁকেই (নুরেজা) সংসার চালাতে হয়।

নুরেজা বেগমের সঙ্গে গতকাল রোববার সকাল নয়টার দিকে কথা হয় রংপুর নগরের দর্শনার বাছিরন নেছা উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে। তখন তিনি ওএমএসের ডিলার মেসার্স তমা ট্রেডার্সের সামনে বিক্রয়কেন্দ্রে জড়ো হওয়া অন্য কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শতাধিক নারী-পুরুষ চাল ও আটা কেনার অপেক্ষায় ছিলেন।

নুরেজা বলেন, গত শুক্রবার তিনি জমিতে আলুবীজ লাগানোর কাজ করেছিলেন। মজুরি পেয়েছেন ৩০০ টাকা। সেই টাকা নিয়ে এসেছেন ওএমএসের চাল ও আটা কিনতে। তিনি আরও বলেন, ‘বাজারে চাল ৬০-৬৫ ট্যাকা নেয়। বাজারে যাই, দাম শুনি আর ঘুরি আসি। এখ্যান থাকি ৫ কেজি চাউল-আটা নিয়্যা গেইলে কয় দিন খাওয়া যাইবে।’

রংপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় রংপুর নগরের ১৭টি কেন্দ্রে চাল ও আটা বিক্রি কার্যক্রম চালু আছে। একটি কেন্দ্রে প্রতিদিন ১ মেট্রিক টন (১০০০ কেজি) করে চাল ও ১ মেট্রিক টন করে আটা বিক্রি হচ্ছে। একজন ভোক্তা সর্বোচ্চ ৫ কেজি করে চাল ও আটা কিনতে পারবেন। ভোক্তাপর্যায়ে প্রতি কেজি চাল ও আটার দাম যথাক্রমে ৩০ ও ২৪ টাকা।

রংপুর নগরে অন্তত পাঁচটি চাল ও আটা বিক্রয়কেন্দ্র ঘুরে নুরেজার মতো অসংখ্য নারী-পুরুষকে পাওয়া গেল, যাঁরা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সংসার চালাতে ভিড় করছেন ওএমএসের বিক্রয়কেন্দ্রগুলোয়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ওয়াজেদুল ইসলাম তাঁদের একজন। তাঁর বাড়ি নগরের আক্কেলপুরে। তিনি কারমাইকেল কলেজ-সংলগ্ন লালবাগে মুরগির ব্যবসা করেন। তিনিও চাল-আটা কিনতে এসেছেন। ওয়াজেদুল বলেন, দিনে ৫০০ টাকা আয় করতে কষ্ট হয়। কিন্তু ৫০০ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে সওদা ব্যাগের তলায় থাকে। ৮০ টাকা আলুর কেজি, এটা কেনা সম্ভব? সন্তানদের পড়াশোনা করাতে হবে না?

মের্সাস তমা ট্রেডার্সের চাল ও আটা দিচ্ছিলেন ডিলার মঞ্জুরুল ইসলামের ভাই রাইসুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কেন্দ্রে ২০০ ব্যক্তিকে চাল ও আটা দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু মানুষ আসেন ৩৫০ থেকে ৪০০ জন। ফলে সবাই পান না। বেলা দুইটা থেকে তিনটা পর্যন্ত বিতরণ শেষে ৫০-৬০ জনকে শূন্য হাতে ফেরত যেতে হয়।

বাংলাদেশে কাজ করা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর যৌথভাবে পরিচালিত ‘সমন্বিত খাদ্যনিরাপত্তার পর্যায় চিহ্নিতকরণ’ শীর্ষক জরিপে বলা হয়েছে, খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষের বেশির ভাগ বাস করেন চট্টগ্রাম, রংপুর, খুলনা ও সিলেট বিভাগে। দেশের ৪০টি এলাকায় খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, ৩৩টি এলাকার মানুষ সংকটজনক অবস্থায় রয়েছে।

রংপুর জেলা কৃষক সমিতির সভাপতি আমজাদ সরকার প্রথম আলোকে বলেন, রংপুর দারিদ্র্যপীড়িত। এখানকার মানুষের আয় কম, দিনমজুর বেশি। একজন দিনমজুর দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করেন। এই দিয়ে তাঁর পরিবারের পাঁচ থেকে ছয়জন সদস্যের খাদ্যের চাহিদা, কাপড়, সন্তানের শিক্ষার খরচ ও চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তাঁরা দিশাহীন।

গতকাল বেলা ১১টার দিকে রংপুর মডার্ন মোড়ে ওএমএস ডিলার তালহা এন্টারপ্রাইজের বিতরণকেন্দ্রে গিয়ে দরিদ্র মানুষের ভিড় দেখা যায়। সেখানে চাল ও আটা পাওয়ার অপেক্ষায় থাকা আশিয়া বেগম বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তাঁরা তিন বেলা খেতে পারেন না। সেখানে আলাপকালে কয়েকজন নারী জানান, ভিড়ের কারণে বেশির ভাগ সময় তাঁদের চাল ও আটা না নিয়েই ফিরে যেতে হয়।
তালহা এন্টারপ্রাইজের সামনে কথা হয় জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের খাদ্য পরিদর্শক অনিমেশ রায়ের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনেক দূরদূরান্ত থেকে গরিব মানুষ এসে চাল ও আটা কেনেন। এ কারণে কেন্দ্রগুলোয় বেশি ভিড় থাকে। রংপুর নগরের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের শেখপাড়া ওএমএস বিক্রয়কেন্দ্র লোকজনের ভিড় সবচেয়ে বেশি হয় বলেও জানান তিনি।

পরে দুপুর ১২টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, শতাধিক নারী-পুরুষ বসে আছেন। ডিলার লাল মিয়া ৫ কেজি চাল ও ৪ কেজি করে আটা দিচ্ছেন। লাল মিয়া বললেন, কোনো দিন লোকসংখ্যা ৪৫০ থেকে ৫০০ হয়। এ কারণে চাল ও আটা ভাগ করে দেন তিনি।

শেখপাড়া বিক্রয়কেন্দ্রে কথা হয় লাইনে বসে থাকা আছিয়া বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রেশন কার্ডে (টিসিবির কার্ড) চেয়ার‌ম্যান, মেম্বার টাকা নিয়ে গরিব মানুষোক বাদ দিছে। বাজারে লবণ, পেঁয়াজ, মরিচ, আলুর আগুন দাম। হামরা চলি ক্যামনে। সরকারোত যা–ই আসুক, হামরা কেমন করি বাঁচি আছি, খেয়াল করে না।’