বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় এক আওয়ামী লীগ নেতাসহ বম জনগোষ্ঠীর তিনজনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় বমপাড়াগুলোতে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তিনজনের লাশ বান্দরবান সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্ত করা হয়। পরে বম সোশ্যাল কাউন্সিলের (বিএসসি) সভাপতির কাছে লাশগুলো হস্তান্তর করা হয়।
এর আগে আজ সকাল থেকে জেলা শহরে ও আশপাশে বসবাসরত বম এবং বিএসসির নেতারা হাসপাতাল প্রাঙ্গণে আসেন। কিন্তু তাঁরা সংবাদমাধ্যমের কারও সঙ্গে কথা বলতে চাননি।
লাশ তিনটি রোয়াংছড়ি উপজেলার সদরের সুয়ানলুপাড়ায় পৌঁছালে পাড়ার অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা ভিড় করেন। জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লক্ষ্মীপদ দাশ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি চহ্লামং মারমার নেতৃত্বে ফুলের তোড়া দিয়ে নেতা–কর্মীরা নিহত ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা জানান। পরে সংগঠনের উপজেলা কার্যালয়ে প্রতিবাদ সভা করা হয়।
গতকাল সোমবার রৌনিনপাড়া থেকে উপজেলা সদরে সরকারি বরাদ্দের চাল নিতে আসার সময় পাইংখিয়ংপাড়া এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন তিনজন। তাঁরা হলেন নেমথাং বম (৪৩), লাললিয়ান বম ওরফে পালম (৩২) ও সিমলিয়ান থাং বম (৩০)। রোয়াংছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি চহ্লামং মারমা বলেন, নিহত নেমথাং বম রোয়াংছড়ি সদর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। অপর দুজন তাঁদের দলের সমর্থক।
এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের শনাক্ত করা যায়নি বলে মঙ্গলবার জানিয়েছেন পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম। আর রোয়াংছড়ি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সাইফুল ইসলাম বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় থানায় এখনো কোনো মামলা হয়নি।
এর আগে গত ৭ এপ্রিল একই উপজেলার খামতাংপাড়ায় বম জনগোষ্ঠীর আটজন নিহত হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছয়জন জুরভারংপাড়ার ও একজন পাইংখিয়ংপাড়ার বাসিন্দা। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ও গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফের গোলাগুলিতে ওই আটজন নিহত হন বলে সে সময় পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন। আর ২২ মার্চ রামথারপাড়া বৃদ্ধ কার্বারিকে (পাড়াপ্রধান) গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তিনজনকে হত্যার ঘটনায় পাইংখিয়ংপাড়া, ক্যাপলংপাড়া, রৌনিনপাড়া, জুরভারংপাড়াসহ বিভিন্ন বমপাড়ার পুরুষ সদস্যরা আতঙ্কে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছেন।
উপজেলা সদরে আশ্রয় নেওয়া বম জনগোষ্ঠীর একজন প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত বছরের অক্টোবর থেকে অশান্ত পরিস্থিতি চলতে থাকায় পাড়াগুলোতে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। জেলা পরিষদ থেকে ২০ কেজি করে চাল বিতরণ করার খবরে সবাই খুশি হয়েছিলেন। অনেকে চাল নিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তিনজনকে গুলি করে হত্যার পর এখন পুরুষেরা বাড়িতে থাকতে ও বাজারে যেতে ভয় পাচ্ছেন।
পাইংখিয়ংপাড়ার এক বাসিন্দা বলেন, প্রায় এক বছর ধরে কোনো কাজকর্ম করতে পারছেন না। এখন সবার ঘরে অভাব। গতকাল গুলির শব্দ শুনে এক কাপড়ে বাড়ি ছাড়েন। সারা দিন না খেয়ে ছিলেন। আজ (মঙ্গলবার) গোপনে পাড়ায় গিয়ে ভাত এনে খেয়েছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লক্ষ্মীপদ দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনজনকে হত্যার ঘটনায় জড়িত সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের শনাক্ত করা যায়নি। দলীয় প্রতিবাদ সভায় আমরা হত্যাকারী ও অবৈধ অস্ত্রধারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানিয়েছি। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে প্রাথমিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিংয়ের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে।’
২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার দুর্গম এলাকায় ও রাঙমাটির বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নে নতুন সংগঠন কেএনএফের তৎপরতার বিষয়টি জানাজানি হয়। তখন থেকে সেখানে অশান্ত অবস্থা চলে আসছে।
কেএনএফের গোপন আস্তানায় সমতলের জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের সংবাদের ভিত্তিতে দুই সংগঠনের বিরুদ্ধে গত বছরের ৩ অক্টোবর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান পরিচালনা করছে। এপ্রিল থেকে অন্য একটি সশস্ত্র দলের সঙ্গে কেএনএফের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে।