গুলিতে নিহত মিজানুর রহমানের স্ত্রী ঝর্ণা বেগমের (মাঝখানে) আহাজারি থামছেই না। গতকাল শনিবার দুপুরে চাঁদপুর শহরের রহমতপুর কলোনি এলাকায়
গুলিতে নিহত মিজানুর রহমানের স্ত্রী ঝর্ণা বেগমের (মাঝখানে) আহাজারি থামছেই না। গতকাল শনিবার দুপুরে চাঁদপুর শহরের রহমতপুর কলোনি এলাকায়

‘আমি এখন ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ক্যামনে করামু, ক্যামনে সংসার চালামু’

‘মসজিদে নামাজ পড়ার পর বাসায় আওনের পথে আমার স্বামীরে গুলি কইরা মাইরা ফেলল। কারা গুলি করল, কেন করল? সে কোনো রাজনীতি করত না, খুবই নিরীহ ছিল। আমি এখন ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ক্যামনে করামু, ক্যামনে সংসার চালামু?’

গতকাল শনিবার দুপুরে কাঁদতে কাঁদতে এসব কথা বলেন ঝর্ণা বেগম। তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকায় সংঘর্ষের সময় গুলিতে নিহত মিজানুর রহমান ওরফে মিলনের (৪৮) স্ত্রী।

নিহত মিজানুর রহমানের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার উপাদী দক্ষিণ ইউনিয়নের পিংড়া গ্রামে। তাঁর পরিবার চাঁদপুর শহরের রহমতপুর কলোনি এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকে। গতকাল শনিবার দুপুরে রহমতপুর কলোনি এলাকায় মিজানুরের ভাড়া বাসায় গিয়ে স্বজনদের আহাজারি করতে দেখা যায়। নিহত মিজানুরের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, শ্যালক, ভাইবোন ও অন্যান্য স্বজনের চোখেও পানি।

কান্নাভেজা কণ্ঠে ঝর্ণা বেগম বলেন, তাঁর স্বামীর কোনো সম্পদ নেই। গ্রামে সম্পদ বলতে ছোট্ট একটি টিনের ঘর। স্বামীর আয়েই সংসার চলত। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ চলত। এখন সব শেষ। কীভাবে সংসার চালাবেন, ছেলেমেয়ের খরচ চলবে, তা আল্লাহই জানেন।

গত ২১ জুলাই (রোববার) বিকেলে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের সময় ঢাকার নর্দা-গুলশান এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মিজানুর। ২২ জুলাই মতলব দক্ষিণের পিংড়া গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়।

নিহত মিজানুর রহমান

স্বজন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নিহত মিজানুর রহমান পিংড়া গ্রামের মৃত খলিলুর রহমানের ছেলে। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে মিজানুর সবার ছোট ছিলেন। মিজানুর ঢাকার নর্দা এলাকায় একটি বিউটি পার্লারে কাজ করতেন এবং ওই এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় একাই বসবাস করতেন। তাঁর বড় ছেলে মো. রবিউলি আলম চাঁদপুরের একটি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে এবং মেয়ে ফারজানা আক্তার স্থানীয় একটি স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাঁর স্ত্রী চাঁদপুর শহরের রহমতপুর কলোনিতে ভাড়া করা বাসায় থাকেন।

মিজানুরের চাচাতো ভাই অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা মো. শাহজালাল তপাদার ও কলেজশিক্ষক মনিরুজ্জামান জানান, ২১ জুলাই বিকেলে ঢাকার নর্দা এলাকায় একটি মসজিদে নামাজ শেষে হেঁটে বাসায় ফিরছিলেন মিজানুর। এ সময় কিছুটা দূরে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল। হঠাৎ পেছন থেকে একটি গুলি তাঁর পিঠে বিদ্ধ হয়। স্থানীয় লোকজন তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। খবর পেয়ে স্বজনেরা সেখান থেকে তাঁর লাশ গ্রামের বাড়িতে এনে দাফন করেন।

অশ্রুসিক্ত মিজানুরের ছেলে মো. রবিউল আলম বলেন, ‘কী দোষে আমার বাবাকে গুলি করে মারা হলো? আমার কাছে আমার বাবাই সব, আমার পৃথিবী। বাবাকে হারানোর যে কী কষ্ট, তা কাউকে বোঝাতে পারব না। বাবার স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেষ করে ভালো চাকরি নেব, মানুষের মতো মানুষ হব। সে স্বপ্ন এখন প্রায় মাটি। আমি বাবা হত্যার বিচার চাই।’

নিহত মিজানুরের শ্যালক মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, তাঁর দুলাভাই শান্ত স্বভাবের মানুষ ছিলেন। রাজনীতি করতেন না। এ হত্যাকাণ্ড মেনে নেওয়া কঠিন।