৪৮ বছর আগের কথা। ১৯৭৬ সালের শীতের এক বিকেল। চট্টগ্রাম তখনো আজকের মতো ইট, কাঠ ও পাথরের দখলে যায়নি। ঘন ঝোপঝাড়, গাছপালা আর পাহাড় পরিবেষ্টিত ছিল। শহরের নন্দনকানন এলাকায় বন বিভাগের পাহাড়টি ছিল ছোটখাটো বনের মতো। খাড়া রাস্তা ধরে পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে পুরো চট্টগ্রাম দেখা যেত পাখির চোখে। তাই প্রায়ই যাওয়া হতো সেখানে তাজা বাতাসের লোভে।
সেদিন বিকেলে সেই পাহাড়ের রাস্তায় হঠাৎ থমকে যেতে হলো। সামনে মারমুখো এক শিয়াল। এমনিতেই শিয়াল লাজুক আর ভীরু হয় বলে শুনেছি; কিন্তু নির্জন রাস্তায় এমন ভাবভঙ্গি দেখে সুবিধার ঠেকল না। তাই পিছু হটার সিদ্ধান্ত নিতে হলো। পেছন ফিরতেই দেখি আরেকজন, মুখে আস্ত একটি মুরগি। দুজনের মাঝখানে পড়ে পাশে লাফ দিয়ে সরে যাই। লক্ষ্য করি, মানুষ ছেড়ে ওই দুই স্বজাতি মুরগি নিয়ে বিবাদে মেতেছে। সে যাত্রায় তাই পালিয়ে রক্ষা।
চট্টগ্রামের ভাষায় শিয়ালকে বলে ‘ইয়াল’। ধূর্ত কোনো লোকের বুদ্ধির প্রশংসা করতে বলা হয় ‘ইয়াইল্লা বুদ্ধি’। অর্থাৎ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে শিশুতোষ গল্প ও ছড়ায় শিয়ালকে যেমন বুদ্ধিমান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, চট্টগ্রামেও তার ব্যতিক্রম হয়নি; কিন্তু চট্টগ্রামের শিয়ালেরা আসলেই কি বুদ্ধিমান? বুদ্ধিমান বা ধূর্তরা তো যেকোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে টিকে থাকে; কিন্তু এই শহরের শিয়ালগুলো আসলে বুদ্ধির জোরে টিকে থাকে পেরেছে? নন্দনকানন, বাটালি পাহাড়, পাহাড়তলী, টাইগার পাস, প্রবর্তক পাহাড়, লালখানবাজার, সলিমপুর, সারসন রোড, হালিশহর, পতেঙ্গা, অক্সিজেন, বাকলিয়া কিংবা ফয়’স লেক এলাকার শিয়ালেরা আজ কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কেউ নেই। নন্দনকাননের বন বিভাগের পাহাড় ও পাশে ডিসি পাহাড়ে এখন দিনের বেলায় শিয়াল কাউকে পথ রোধ করা দূরের কথা, রাতের বেলায়ও তাদের ডাক শোনা যায় না।
নন্দনকানন এলাকার ডিসি পাহাড়ের ফটকে বসে থাকা নিরাপত্তা কর্মীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি এখানে কখনো শিয়াল দেখেছেন কি না। প্রশ্ন শুনে তিনি ভড়কে গিয়েছিলেন তিনি। পরে অবাক হয়ে বললেন, শিয়াল থাকবে কেন?
তার অভিব্যক্তিতে মনে হলো, এমন অভিজাত পার্কে শিয়াল কেন আসবে। অথচ ডিসি পাহাড় সেদিনও ছিল শিয়ালের ডেরা। লোকজন সন্ধ্যার পর সেদিক দিয়ে একা যেতে ভয় পেত একসময়। খাটো এক পরিচিত ভদ্রলোক একবার অতিথি হয়ে এসেছিলেন আমার নন্দনকাননের বাসায়। রাত হয়ে গেছে বলে তিনি অনুরোধ করেছিলেন, তাঁকে ডিসি পাহাড় এলাকা পার করে দিতে। পূর্ণবয়স্ক কোনো মানুষের এমন ভয় পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘শিয়াল কি জানে তিনি চাকরিবাকরি করা সংসারি মানুষ?’ ডিসি পাহাড়ে শিয়াল ধরে, জবাই করে বিক্রি করার ঘটনাও একসময় অনেকে দেখেছেন; কিন্তু এখন সেসব কেবল গালগপ্প।
প্রবর্তক পাহাড়ে ইসকন মন্দিরের পাশে ডাব বিক্রি করেন আসমা বেগম। এলাকার পুরোনো বাসিন্দা তিনি। ওই এলাকায় দেখা হয় তাঁর সঙ্গে। শিয়ালের কথা জানতে চাইলে তিনি হেসে বলেন, ‘ওবা মানুষ থাইবার জাগা নাই, অনে ইয়ালর হথা হঅন দে না?’
তবে দুই মাস আগে হঠাৎ এক রাতেই প্রবর্তক এলাকার কাছেই দুটি শিয়ালের দেখা পাই। দুই পাহাড়ের মাঝখানের পথ সারসন রোডে শিয়াল দুটি ডাস্টবিনে খাদ্য খোঁজার কাজে মগ্ন ছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম কুকুর; কিন্তু কাছে যেতেই ভুল ভাঙল। ‘মুরগি চোরা’ শিয়ালের খাদ্যও নেই এই শহরে। কুকুরের মতো তারও আজ ডাস্টবিনের দ্বারস্থ। অথচ চট্টগ্রাম একসময় শিয়ালসহ নানা বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রম ছিল।
১৯২০ সালে প্রকাশিত চৌধুরী পূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধির ইতিহাস গ্রন্থ ‘চট্টগ্রামের ইতিহাসে’ তার উল্লেখ রয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামের প্রায় সবখানে বন্য হস্তী, নানা প্রকারের হরিণ, বানর, হনুমান, বন্য বরাহ, শজারু, বাগডাস, কাঠবিড়াল, বনবিড়াল, খান্ডাস, গোরখোঁদা, শৃগাল, রামকুত্তা চোখে পড়ত। মাঝে মাঝে গন্ডার, ভাল্লুক ও উল্লুকও পাওয়া যেত।’
বর্তমানে চট্টগ্রামের প্রাণিকুলের কী অবস্থা তার কোনো জরিপ নেই বন কর্মকর্তাদের কাছে। তবে বন গবেষণা ইনস্টিটিউট ক্যাম্পাস ও পাশের ষোলোশহর এলাকায় বর্তমানে ১০৬ ধরনের বন্য প্রাণীর অস্তিত্ব আছে বলে জানান ইনস্টিটিউটের বন্য প্রাণী শাখার ঊর্ধ্বতন গবেষণা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনিসুর রহমান। এই ১০৬ ধরনের প্রণীর মধ্যে রয়েছে পাখি, স্তন্যপায়ী, উভচর ও সরীসৃপ। এর মধ্যে শিয়ালও রয়েছে। এই এলাকায় গাছপালা বাড়ানো এবং বন্য প্রাণীর জন্য অনুকূল পরিবেশ থাকায় এখানে সেগুলোর সংখ্যা বাড়ছে। তবে বলাই বাহুল৵ এই পরিসংখ্যান পুরো চট্টগ্রামের নয়। মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বলেন, ‘বন গবেষণা ইনস্টিটিউট ছাড়া শহরের অন্য কোনো জায়গায় এতগুলো বন্য প্রাণী পাওয়া যায় না।’
চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহাম্মদ ইয়াসিন নেওয়াজ বন্য প্রাণী হারিয়ে যাওয়ার জন্য অপরিকল্পিত নগরায়ণকেই দায়ী করলেন। তিনি বলেন, শুধু শিয়াল নয়, বন্য প্রাণীর বসবাসের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ—ঝোপঝাড়, গাছপালা, অযান্ত্রিক পরিবেশ নেই এখানে।
২০২২ সালে প্রকাশিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের’ অধ্যাপক জি এন তানজিনা হাসনাত ও একই বিভাগের মোহাম্মদ আলীর লেখা এক প্রবন্ধে বলা হয়, গত ৩০ বছরে চট্টগ্রামে পাহাড়-জঙ্গলের সবুজ কমেছে ২১ দশমিক ৮২ শতাংশ আর পুকুর-জলাশয় কমেছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ১৯৯০ সালে নগরের মাত্র ১৯ শতাংশ এলাকায় বসতি থাকলেও এখন ৪৫ শতাংশ এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে।
সপ্তদশ শতকের ঐতিহাসিক ও পর্যটক শিহাবউদ্দিন তালিশ তাঁর ‘ফতিয়া ই ইব্রিয়া’ বইতে চট্টগ্রামের প্রকৃতি ও পাহাড়কে আলেক্সান্ডারের দুর্গের মতোই দুর্ভেদ্য বলে বর্ণনা করেছেন। সেই দুর্ভেদ্য পাহাড়শ্রেণি আর তার পাদদেশে সমতল ছিল নিবিড় গাছপালায় ঢাকা। চট্টগ্রাম ছিল বিপুল জীববৈচিত্র্যে ভরা এক জনপদ। কিন্তু কালে কালে সেই পাহাড়, অরণ্য ও জলাভূমি নিশ্চিহ্ন হয়েছে। আর এই প্রকৃতিকে ঘিরে বিকশিত প্রাণিকুলের সমাজটাও সংকুচিত হয়েছে। এই শহরের শিয়ালেরা হয়তো সেই পরিণতি মেনে নিয়ে ঠাঁই নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়।