কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলা শহর থেকে চিলমারী নদী বন্দর যেতে রাস্তার দুই পাশে সারি সারি মিষ্টির দোকান চোখে পড়ে। সাইনবোর্ডে পাবনা মিষ্টান্ন ভান্ডার, ১ নম্বর পাবনা ভাগ্যলক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডার, আসল পাবনা মিষ্টান্ন অ্যান্ড দধিঘর, ওকে হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, পাবনা মিষ্টান্ন অ্যান্ড দধিঘর, বনফুল মিষ্টান্ন ভান্ডার—এমন অনেক নাম। তবে দোকানগুলোতে নেই কোনো বাহারি সাজসজ্জা। এসব দোকানে তৈরি হয় সুস্বাদু ‘ক্ষীরমোহন’ মিষ্টি।
উলিপুরের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন ‘ক্ষীরমোহন’ ক্ষীর ও মোহনের সংমিশ্রণে তৈরি। ক্ষীর হলো মিষ্টির রস। গাভির দুধ দীর্ঘ সময় জ্বাল দিয়ে এর সঙ্গে নানা পদের মসলা মিশিয়ে তৈরি করা হয় এই রস। স্থানীয়ভাবে মিষ্টির এই রসকে ক্ষীর বলা হয়। অন্য দিকে মোহন বলতে মিষ্টির সাদা অংশকে বোঝানো হয়। দুধ দীর্ঘ সময় জ্বাল দিয়ে ছানা তৈরি করে নিয়ে এর সঙ্গে পরিমাণমতো চিনি ও সামান্য ময়দা মিশিয়ে তৈরি হয় এই মিষ্টি। এরপর চিনির শিরায় ডুবিয়ে আগুনের আঁচে জ্বাল দিতে হয়। পরে ক্ষীরের মধ্যে ডুবিয়ে সামান্য জ্বাল দিলেই তৈরি হয় ক্ষীরমোহন। দুধ যত খাঁটি হবে, ক্ষীরমোহন তত ভালো হবে—সুস্বাদু ক্ষীরমোহনের এটাই প্রকৃত রহস্য।
উলিপুরের প্রবীণ মিষ্টি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৫৮ সালে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের সুধীর সরকার উলিপুরে এসে মিষ্টি ব্যবসায়ী কছির মিয়ার দোকানে কারিগর হিসেবে চাকরি নেন। সে সময় তিনি প্রথম ক্ষীরমোহন তৈরি করেন। অল্পদিনেই তাঁর এই মিষ্টির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর দেখাদেখি অনেকেই এই মিষ্টি বানাতে শুরু করেন।
মিষ্টির দোকানগুলোর মধ্যে ‘ওকে হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’ তুলনামূলক পুরোনো। এটির প্রতিষ্ঠাতা শামসুল আলম বলেন, স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এসে এখানে ক্ষীরমোহন খান। প্যাকেটে করে বাসার জন্য নিয়ে যান। কুয়েত, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসীরা সেখানে যাওয়ার সময় ক্ষীরমোহন নিয়ে যান।
‘আসল পাবনা মিষ্টান্ন অ্যান্ড দধিঘর’–এর যাত্রা ৩৫ বছর আগে। অল্প সময়েই এ দোকানের ক্ষীরমোহনের স্বাদ মানুষের মন ভুলিয়েছে। এই দোকানের মালিক হরিপদ ঘোষ বলেন, আগে সিরাজগঞ্জে তাঁদের পূর্বপুরুষদের দইয়ের ব্যবসা ছিল। ১৯৮৮ সালে তিনি কুড়িগ্রামের উলিপুরে এসে মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। এক কেজি ক্ষীরমোহন তৈরি করতে সাড়ে তিন কেজি দুধ লাগে। তাই গরুর দুধের দামের ওপর ক্ষীরমোহনের বাজারমূল্য ওঠানামা করে। বর্তমানে এক কেজি ক্ষীরমোহন ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়। দৈনিক গড়ে ক্ষীরমোহন ৩০ কেজি, অন্যান্য মিষ্টি ২০ থেকে ৩০ কেজি বিক্রি হয়।
উপজেলার ধরণীবাড়ি থেকে ক্ষীরমোহন কিনতে এসেছেন জরীফ উদ্দীন (৩০)। তিনি বলেন, ‘আমাকে কেউ যদি প্রশ্ন করে, কুড়িগ্রাম জেলার ঐতিহ্যবাহী খাবারের নাম কী? আমি একবাক্যে বলব—উলিপুরের ক্ষীরমোহন। উলিপুর উপজেলা শহরে সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন আসতে হয়। যখনই আসি, একটি হলেও ক্ষীরমোহন খাই। কলেজে পড়ার সময় এমনও দিন গেছে, দুপুরে ভাতের টাকায় ক্ষীরমোহন খেয়েছি।’
কুড়িগ্রামের মানুষের কাছে ঈদ, পূজা, বিয়ে বা অন্য কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে অতিথি আপ্যায়ন ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রিয় নাম ‘ক্ষীরমোহন’।