ফরিদপুরের ভাঙ্গার যে রসগোল্লা শতাধিক বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, তার নাম ‘অনিল দাসের রসগোল্লা’। মিষ্টিপ্রেমীদের কাছে সব সময়ই এই রসগোল্লার চাহিদা আছে। তিন পুরুষ ধরে স্বাদে–মানে মানুষের মনে জায়গা ধরে রেখেছে এই রসগোল্লা।
এই মিষ্টির দোকানের মালিকদের পূর্বপুরুষ মাদারীপুরের মোস্তফাপুর এলাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় আসেন। যামিনী কান্ত দাস ভাঙ্গা কোর্টপাড় (বর্তমানে ভাঙ্গা টাউন) এলাকায় প্রথম দোকান দিয়ে রসগোল্লা বিক্রি শুরু করেন। শুরুতেই মানুষের মন জয় করে নেয় এই মিষ্টি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুনাম আরও ছড়ায়।
যামিনী কান্ত দাসের দুই ছেলে। বড় ছেলে মনোরঞ্জন দাস আর ছোট ছেলে অনিল রঞ্জন দাস। একসময় বাবার সঙ্গে মিষ্টি ব্যবসার হাল ধরেন ছোট ছেলে অনিল। এভাবেই ‘অনিল দাসের রসগোল্লা’র নাম হয়। অনিলের চার ছেলে। পড়াশোনা করে বড় ছেলে শ্যামল কান্তি দাস স্বাস্থ্য বিভাগে, দ্বিতীয় ছেলে কমলকান্তি দাস বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় অধিদপ্তরে, তৃতীয় ছেলে কাজল কান্তি দাস সোনালী ব্যাংকে চাকরি করেছেন। তবে ছাত্রজীবন থেকে বাবার ব্যবসার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন ছোট ছেলে বিশ্বজিৎ দাস। ১৯৯৮ সালে অনিল রঞ্জন দাসের মৃত্যুর পর ছোট ছেলে বিশ্বজিৎ দোকান পরিচালনার দায়িত্ব নেন।
ভাঙ্গার কোর্টপাড় এলাকায় সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের সামনের সড়ক দিয়ে কয়েক গজ গেলে হাতের ডান পাশে ‘আদি অনিল দাস’ নামে মিষ্টির দোকান চোখে পড়ে। এখানে তিন ধরনের রসগোল্লা আছে। বড় আকারের রসগোল্লা ‘রাজভোগ’ নামে পরিচিত। এর প্রতিটি ৪০ টাকা করে বিক্রি হয়। দুধের দাম বাড়লে এই মিষ্টি প্রতিটি ৫০ টাকাও হয়। মাঝারি আকারের রসগোল্লা প্রতিটি বিক্রি হয় ২০ টাকা করে। আর ছোট আকারের রসগোল্লা প্রতিটি বিক্রি হয় ১০ টাকায়। রসগোল্লার পাশাপাশি খিরের চমচম, ছানা, দই ও পান্তুয়া বিক্রি হয় এই দোকানে।
ভাঙ্গা পৌরসভার কোর্টপাড় এলাকার বাসিন্দা জহিরউদ্দিন আহমেদ (৬০) বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই এই মিষ্টি আমাদের অত্যন্ত প্রিয়। তাদের দোকানের রসগোল্লার স্বাদ আলাদা। ভাঙ্গায় বিশিষ্ট কোনো ব্যক্তি এলে এই দোকানের মিষ্টি দিয়েই আপ্যায়ন করা হয়।’
নগরকান্দা উপজেলার গহেরনামা গ্রাম থেকে আসা মাসুদুর রহমান (৬৪) বলেন, ‘৪০-৪২ বছর ধরে এই দোকানে মিষ্টি খাই। এই এলাকায় কোনো কাজে এলে তাদের রসগোল্লা খাবই। এই রসগোল্লার আলাদা স্বাদ।’
‘আদি অনিল দাস’ মিষ্টির দোকানের বর্তমান মালিক বিশ্বজিৎ দাস (৫৯) বলেন, ‘আমার ঠাকুরদাদা ও বাবার আমলের মিষ্টির ঐতিহ্য আমরা সব সময় ধরে রাখার চেষ্টা করছি। গুণগত মানের ক্ষেত্রে কখনোই আপস করিনি। বাবার কাছে শুনেছি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাঙ্গার নূরপুর গ্রামে তাঁর ফুপুর বাড়িতে বেড়াতে এলে আমাদের দোকানের মিষ্টি নিতে বলতেন।’
ফরিদপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাহাদাত হোসেন ভাঙ্গা পৌরসভার মধ্যপাড়া হাশামদিয়া মহল্লার বাসিন্দা। তিনি বলেন, ‘এই মিষ্টি আমাদের ঐতিহ্য। ভাঙ্গার ইতিহাসের সঙ্গে এই মিষ্টির নাম মিশে গেছে। ভাঙ্গা গোলচত্বর হওয়ার পর তাদের বিক্রি তো ১০ গুণ বেড়ে গেছে।’ অন্য রসগোল্লার চেয়ে এর ভিন্নতা কী, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই মিষ্টি মুখে দিলে মোমের মতো গলে যায়। ছানার স্বাদ যেন মুখে লেগে থাকে। একটি মিষ্টি খাওয়ার পর আরেকটি না খেয়ে থাকা যায় না।’