ট্রেনের শব্দ শুনেই বাড়ি থেকে ছুটে এলেন ইছহাক

চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেললাইনে প্রথমবারের মতো চলেছে পরিদর্শন ট্রেন। আজ দুপুরে চন্দনাইশের দোহাজারি এলাকায়
ছবি জুয়েল শীল

নতুন রেললাইন দিয়ে ট্রেন যাওয়ার দৃশ্য দেখার ইচ্ছা ছিল। তাই ট্রেনের শব্দ শুনেই বাড়ি থেকে ছুটে এসেছিলেন ষাটোর্ধ্ব মো. ইছহাক সওদাগর। শঙ্খ নদের সেতু পেরিয়ে ট্রেনটা তখন দাঁড়িয়েছে সাতকানিয়ার কালিয়াইশ ইউনিয়নের এক জায়গায়। এখানে পরিদর্শকেরা নামবেন। রেললাইন, সেতু, স্টেশনসহ সব অবকাঠামো পরীক্ষা করবেন। এভাবে নানা জায়গায় থেমে পরীক্ষা করতে করতে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত যাচ্ছেন তাঁরা। সঙ্গে রয়েছেন গণমাধ্যমকর্মীরাও। সে রকম এক যাত্রাবিরতিতে মো. ইছহাকের সঙ্গে কথা হয়। বাড়ির পাশে রেললাইন হবে, সে পথে ট্রেনও চলবে—এমনটা ভাবেননি ইছহাক। আজ সেই অসম্ভব সত্যি হতে দেখছেন বিস্ময়ভরা চোখে।

উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ইছহাক বলেন, এই নতুন রেললাইন তাঁদের জীবন বদলে দেবে। যাতায়াতব্যবস্থা সহজ করবে। ব্যবসা-বাণিজ্যেরও সুবিধা হবে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক সরু হওয়ায় গাড়িতে চলাচল করতে হয় ঝুঁকি নিয়ে। এখন এই দুশ্চিন্তা থাকবে না। আর মালামাল নির্বিঘ্নে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে আনা-নেওয়া করা যাবে।

চট্টগ্রামের চন্দনাইশের দোহাজারী স্টেশনের পর শঙ্খ নদ। এরপরেই শুরু সাতকানিয়া উপজেলা। শঙ্খ নদের চন্দনাইশ প্রান্তে এসে শেষ হয় রেললাইন। তাই ট্রেন নিয়ে কিছুটা হলেও আক্ষেপ ছিল সাতকানিয়ার কালিয়াইশ ইউনিয়নের বাসিন্দাদের। তবে তাঁদের সে আক্ষেপ দূর হতে যাচ্ছে।

পরিদর্শন ট্রেন দেখতে মানুষের ভিড়। আজ দুপুরে কক্সবাজারের চকরিয়া স্টেশনে

শঙ্খ নদের দক্ষিণ প্রান্তের বাসিন্দাদের জন্য আজ রোববারের দিনটা যেন বিশেষ দিন ছিল। দুপুর ১২টায়  চন্দনাইশের দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া প্রথম পরিদর্শন ট্রেন শঙ্খ সেতু পার হয়ে সাতকানিয়ায় আসে। প্রথমবার এই পথে ট্রেন দেখতে রেললাইনের পাশে ভিড় জমান সাধারণ মানুষ। ট্রেন চলাচলের মুহূর্ত ধারণ করে রাখেন নিজের মুঠোফোনে। করেন ভিডিও। আবার দুই পাশের বাড়িঘর থেকেও বেরিয়ে আসেন নারী ও শিশুরা। হাত নেড়ে হাসি মুখে শুভেচ্ছা জানান ট্রেনে থাকা ব্যক্তিদের।

মো. শফি নামের এক বিদ্যুৎ মিস্ত্রি বলেন, সড়ক পথে যাতায়াতের কারণে অনেক বেশি চিন্তায় থাকতে হয়। মা-বাবারাও টেনশনে থাকেন তাঁদের সন্তানেরা ঠিকভাবে বাড়ি ফিরতে পারবে কি না। রেললাইন হওয়ায় সে দুশ্চিন্তা আর নেই। এখন অল্প খরচে আর দ্রুত সময়ে নিরাপদে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে আসা-যাওয়া করতে পারবেন।

চকরিয়া স্টেশনে ট্রেন দেখতে মানুষের ভিড়। আজ দুপুরে

প্রবল বন্যায় গত জুলাই মাসে তলিয়ে গিয়েছিল সাতকানিয়ার তেমুহনী এলাকা। এই বন্যার জন্য নতুন রেললাইনকে দায়ী করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে ট্রেন চলাচল শুরুর দিনে সে কষ্ট আর বেদনার কথা মনে করতে চান না স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবির। তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে গেছে নতুন রেললাইন। চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারে দোকান রয়েছে। তবে আজ শহরে যাননি। গ্রামেই ছিলেন। তিনি বলেন, ‘বাড়ির পাশ দিয়ে ট্রেন যাবে তা কখনো ভাবিনি।  অনেক বছর ধরে এই দিনের অপেক্ষায় ছিলেন। কবে এই লাইনের কাজ শেষ হবে, কবে ট্রেন চলাচল শুরু হবে, তা দেখার খুব ইচ্ছা ছিল।  এ জন্য গ্রামে চলে এসেছেন। ট্রেন যাওয়ার দৃশ্য দেখে খুব ভালো লাগছে। একটা স্বপ্ন পূরণ হলো।’  

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারে প্রথমবারের মতো ট্রেন যাচ্ছে আজ। আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের আগে নতুন নির্মিত দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ পরিদর্শনের জন্য এই ট্রেন চালানো হচ্ছে। এর মাধ্যমে নতুন নির্মিত এই রেললাইন যাচাই করে দেখবেন পরিদর্শন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

চট্টগ্রামের চন্দনাইশের একটি গ্রামের বাসিন্দারা ট্রেন দেখার জন্য দাঁড়িয়েছেন। আজ বেলা ১২টায়

আজ সকাল ৯টায় চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে এই ট্রেন কক্সবাজারের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ট্রেনটিতে সরকারি রেল পরিদর্শক রহুল কাদের আজাদ, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. নাজমুল ইসলামসহ সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা আছেন। ট্রেনটিতে আটটি বগি রয়েছে।

সাধারণত দেশের কোথাও নতুন রেললাইন নির্মিত হলে পরিদর্শন অধিদপ্তর পরীক্ষা করে দেখে। অধিদপ্তর ছাড়পত্র দিলে নতুন রেলপথটি ট্রেন চলাচলের জন্য উপযোগী বলে বিবেচনা করা হয়। এরপর ট্রায়াল রান (পরীক্ষামূলক চলাচল) ও আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হয়৷ ১১ নভেম্বর এই রেললাইন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার লাইনের মধ্যে মোট প্রকল্পের কাজ ৯২ শতাংশ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন প্রকল্পটির কাজ ২০১৮ সালে শুরু হয়। আগামী বছরের জুন পর্যন্ত এই প্রকল্পের মেয়াদ থাকলেও তার আগে আগামী ডিসেম্বরের দিকে পুরোপুরি কাজ শেষ হবে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চালানোর জন্য তার আগেই বুঝিয়ে দেওয়া যাবে।