আহত ছাত্র বললেন

‘একটার পর একটা রাবার বুলেট লাগার পর আমি পড়ে যাই’

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাইমুল ইসলাম
ছবি: প্রথম আলো

পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেটে আহত হয়ে রংপুরে মেডিকেলে চিকিৎসাধীন নাইমুল ইসলাম। তিনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। কোটা সংস্কারের আন্দোলন করতে এসে আহত হয়ে হাসপাতালে ঠাঁই হয়েছে তাঁরা। শয্যায় তিনি শুয়ে কাতরাচ্ছিলেন। বুকে-পিঠে রাবার বুলেটের ক্ষত।

হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডের শয্যায় শুয়ে গতকাল মঙ্গলবারের ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে নাইমুল ইসলাম বলেন, ‘সাঈদ (আবু সাঈদ) আমার বড় ভাই। এই কোটা আন্দোলনে এসে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। অল্প সময়ে মধ্যে খুব কাছ থেকে সাঈদ ভাইকে দেখেছি। তাঁর গুলি লাগার পরপরই আমার শরীরেও কয়েকটা গুলি লাগে। আমার থেকে ২০ গজ দূরত্বের মধ্যেই সাঈদ ভাই ছিলেন। একটার পর একটা রাবার বুলেট লাগার পর আমি পড়ে যাই। পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে কয়েকজন বড় ভাই ও ছোট ভাই ধরাধরি করে নিয়ে এসে একটি দোকান থেকে পানি নিয়ে মাথায় ঢালে। এরপর হাসপাতালে নিয়ে আসে বন্ধু-স্বজনেরা।’

আজ বুধবার বেলা একটার দিকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল, ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন পাঁচজন রাবার বুলেটে ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসা নিয়ে ১৯ জন শিক্ষার্থী বাড়ি ফিরে গেছেন বলে হাসপাতালের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাব্বির হোসেনের বাড়ি বগুড়ার কাহালু উপজেলায়। তাঁরও পিঠ, বুক, মাথাসহ বিভিন্ন স্থানে রাবার বুলেটের ক্ষতচিহ্ন। শয্যায় বসে সেই সময়ের ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন তিনি। খুব কাছ থেকে দেখেছেন আবু সাঈদের আহত হওয়ার দৃশ্য। তিনি বলেন, ‘আমারে শরীরে একের পর গুলি (রাবার ‍বুলেট) এসে লাগছে। ঘটনাস্থলে টিকে থাকতে পারছিলাম না। সাঈদ ভাইকে দেখছি, তিনি সরছেন না। আমি পড়ে যাচ্ছিলাম। এমন সময় কয়েকজন বড় ভাই ও ছোট ভাই এসে সেখান থেকে আমাকে সরে নিয়ে যায়। এরপর তারাই মেডিকেলে নিয়ে আসে। হাসপাতালে এসে জানতে পারলাম, সাঈদ ভাই মারা গেছেন।’

পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মাহাবুব চিকিৎসাধীন। ডান হাতে রাবার বুলেটে ক্ষত হওয়ায় ব্যান্ডেজ দেওয়া হয়েছে

রাবার বুলেটের আঘাতে আহত রংপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহাবুব হাসান শুয়ে আছেন শয্যায়। তাঁকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। তাঁর ডান হাত পুরো ব্যান্ডেজ করা। বুকে অনেক রাবার বুলেটের ক্ষতচিহ্ন। তাঁর সঙ্গে বিছানায় কৃষক বাবা আবদুল খালেক বসে আছেন।

মাহাবুব বলেন, ‘আমি কোটা সংস্কার আন্দোলনের মিছিলে যাইনি। আমি কারমাইকেল কলেজের পাশে লালবাগ এলাকায় মেসে থেকে লেখাপড়া করি। প্রতিদিনের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্ক মোড়ে দুপুরের খাবার খেতে গিয়েছিলাম। ওই সময় বিক্ষোভের মধ্যে পড়ে যাই। পুলিশ লাঠিপেটা করে। কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। রাবার বুলেট পিঠ, হাত ও বুকে এসে লাগে। আমাকে কয়েকজন সেখান থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে। ডান হাতে এত বেশি রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়েছে, সে জন্য ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। হাতটার যে কী হবে, তা বলতে পারছি না।’

হাসপাতালের পরিচালক ইউনুছ আলী চিকিৎসাধীন আহত শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। তাঁদের স্বজনদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তিনি বলেন, গতকাল ২৪ জন চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁদের অধিকাংশই চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। এখন পাঁচজন চিকিৎসাধীন। তাঁরা সবাই ভালো আছেন।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ মিনারে বসে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে শিক্ষকেরা

এদিকে শিক্ষার্থী হত্যার বিচার দাবি করে দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ মিনারের পাদদেশে শিক্ষকেরা সমাবেশ করেছেন। সমাবেশে বক্তব্য দেন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান মণ্ডল, অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ, অধ্যাপক উমর ফারুক প্রমুখ।

তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘সাঈদ ছিল সবার প্রিয় শিক্ষার্থী। এমন ঘটনা ঘটেনি যে তাকে গুলি করতে হবে। আমি হাসপাতালে যাওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। তার মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়িও গিয়েছি। আমরা শিক্ষকসমাজ ছাত্র হত্যার ঘটনার বিচার দাবি করছি।’

এরপর শিক্ষকেরা যেখানে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, সেই এক নম্বর ফটকের সামনে দুপুর ১২টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত আধা ঘণ্টা মানববন্ধন করেছেন। বেলা দুইটার দিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আয়োজনে এক নম্বর ফটকের সামনে নিহত আবু সাঈদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা চত্বরটি নিহত শিক্ষার্থী আবু সাঈদের নামে নামকরণ করার ব্যানার টানিয়ে দেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর ফটকটি নিহত শিক্ষার্থী আবু সাঈদের নামে নামকরণ করে শিক্ষার্থীরা

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি থমথমে

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি থমথমে হলেও সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দেখা যায়নি। শান্তিপূর্ণভাবে সকাল থেকে শিক্ষার্থীরা আবাসিক হল ছেড়ে চলে গেছেন। এর মধ্যে তিনটি হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা গতকাল রাতের মধ্যেই হল ছেড়ে চলে যান।

হল ছেড়ে যাওয়ার সময় শিক্ষার্থীদের চোখে–মুখে ছিল ক্লান্তির ছাপ। ট্রলি ব্যাগ টেনে হল ছেড়ে যাওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে। নওগাঁর এক ছাত্রী বলেন, ‘স্নাতকোত্তর পরীক্ষা এই মাসে হওয়ার কথা ছিল। এ পরিস্থিতিতে এখন কবে যে হবে, তা অনিশ্চিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর জানার পর বাড়িতে থেকে মা-বাবা অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। তবে হলে সার্বক্ষণিক স্যারদের সহযোগিতা ছিল।’

সর্বশেষ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি অনুকূলে রয়েছে। ওই এলাকার পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক নজরে রাখা হচ্ছে।

শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতির কক্ষে আগুন দেওয়া হয়েছে। হলের সামনে থাকা একটি গাড়ি ও পাঁচটি মোটরসাইকেলও আগুন দেওয়া হয়েছে। শহীদ মুক্তার এলাহী হলে ছাত্রলীগ কর্মীদের পাঁচটি কক্ষেও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।