আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী জাপা, নাকি ইসলামী আন্দোলন

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে নগরে সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থীদের বিলবোর্ড। সম্প্রতি সকালে চন্দনা চৌরাস্তা এলাকায়
ছবি: মাসুদ রানা

দেশের বৃহত্তম গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আগামী ২৫ মে ভোট গ্রহণের দিনক্ষণ ঠিক করে তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। বিএনপি এই সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় ভোটের মাঠে নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। তবে বিএনপি নির্বাচনে না এলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোন দলের প্রার্থীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, তা নিয়ে ভোটারদের মধ্যে চলছে নানা আলোচনা।

গাজীপুরে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী হচ্ছেন দলটির যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান। দলের নেতারা মনে করেন, গাজীপুরে তাঁদের নিজস্ব ভোটব্যাংক রয়েছে। এদিকে জাতীয় পার্টির (জাপা) গাজীপুর জেলার সভাপতি ও সাবেক সচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিন নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। জাতীয় পার্টির নেতারা মনে করেন, শিল্প–অধ্যুষিত গাজীপুরে রংপুরসহ উত্তরবঙ্গের বহু ভোটার রয়েছেন, যাঁরা জাতীয় পার্টির সমর্থন করেন। তাঁদের ভোটে জাতীয় পার্টির শক্ত একটি অবস্থান রয়েছে। বিএনপির বাইরে এ দুই দলের মেয়র প্রার্থীরা আওয়ামী লীগদলীয় প্রার্থীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির প্রার্থী নির্বাচনে না থাকলেও ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী হয়ে উঠতে পারেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী।

গাজীপুর শহরের বিলাসপুর এলাকার বাসিন্দা মুদিদোকানদার শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভোট হইবো হোনতাছি (শুনছি), কিন্তু ভোটের তো কোনো আমেজ পাইতাছি না। আবার হোনলাম (শুনলাম) বিএনপি নাকি নির্বাচনে থাকব না। বিএনপি যদি না থাকে, তাইলে ভোট হইবো কার লগে?’

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২০১৮ সালে ইসলামী আন্দোলন মেয়র পদে প্রার্থী দিয়েছিল। প্রার্থী ছিলেন দলটির গাজীপুর জেলার আমির নাসির উদ্দিন। এবার তিনি আর প্রার্থী হচ্ছেন না। নতুন প্রার্থী ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনের আমাদের দলের প্রার্থী ভোট পেয়েছিল প্রায় ২৭ হাজার। এবার আমাদের নির্বচনটা হবে ভিন্নভাবে। ব্যাপক কর্মী থাকবে, তারা প্রচার করবে জোরেশোরে। মোটকথা, আমরা এখন মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকছি। তাই আমাদের ভোটব্যাংকের বাইরেও সাধারণ মানুষের ভোটও আমরা পাব। গাজীপুরের ওলামায় কেরাম এবং ইসলামপন্থী শক্তি আজ ঐক্যবদ্ধ। গাজীপুরের মানুষ উৎসবমুখর পরিবেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের অপেক্ষা করছে।’ স্থানীয় প্রশাসন ও সাংবাদিকদের ইনসাফ বজায় রাখার আহ্বান জানান তিনি।

বিএনপি যদি প্রার্থী না দেয়, তবে আওয়ামী লীগের ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলে মন্তব্য করেন গাজীপুরের বাসন এলাকার বাসিন্দা আবদুল লতিফ। তিনি জানান, আওয়ামী লীগের বাইরে প্রচার চালাচ্ছে জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। জাতীয় পার্টির প্রার্থী শেষ পর্যন্ত মাঠে না–ও থাকতে পারেন, সে ক্ষেত্রে মাঠে থাকবেন ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী। ভোটের রাজনীতিতে স্থানীয়ভাবে ইসলামী আন্দোলনের গুরুত্ব বেড়েছে। বিএনপির অনুপস্থিতিতে সিটি নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন বলেই মনে হচ্ছে।

সম্প্রতি গাজীপুরে একটি ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম (শায়খে চরমোনাই)। সে অনুষ্ঠানে তিনি  বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি আজ পথ হারিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম আস্থা ও বিশ্বাস নেই। আসন্ন গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আমরা আগামী জাতীয় রাজনীতির জন্য সুবাতাস তৈরি করতে পারি। আমরা চাই, গাজীপুরের সিটি নির্বাচন হবে আগামী দিনের জাতীয় রাজনীতির পথনির্দেশক। আমরা দেশের জন্য, মানুষের জন্য কল্যাণের রাজনীতি করি। আমরা সৌহার্দ্য ও সমঝোতার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এ জন্যই আমরা গাজীপুরে একজন দক্ষ ও চৌকস জাতীয় রাজনীতিবিদকে মনোনয়ন দিয়েছি, যাতে আগামী দিনের জাতীয় রাজনীতিতে গাজীপুরের সিটি নির্বাচন ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’

সিটি নির্বাচনে ইভিএম এবং প্রতিটি কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা বসানো একটি ভালো দিক মন্তব্য করেন জাপা গাজীপুর জেলার সভাপতি এম এম নিয়াজ উদ্দিন। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করতে হবে। জনগণের আশার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। গাজীপুর সিটিকে একটি পরিকল্পিত উন্নয়নের আওতায় আনা হবে। কেবল অবকাঠামো উন্নয়ন নয়। নগরের প্রকৃত উন্নয়ন করতে হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎসহ সব খাতে উন্নয়ন করতে হবে। পরিকল্পিত শিল্প উন্নয়ন করতে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করবেন। জনগণ পরিবর্তন চায়। তিনি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করবেন।

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খান প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনে না এলেও গাজীপুর সিটি নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হবে। অন্য যে দলের প্রার্থীই থাকুক না কেন, ভোটাররা যদি সুষ্ঠু পরিবেশ পান, তাহলে অবশ্যই সুন্দর একটি নির্বাচন হবে। সাধারণ মানুষের আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা আছে। তাই এসব দলের প্রার্থীর কারণে আওয়ামী লীগের ভোটে কোনো প্রভাব পড়বে না।

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) গাজীপুর শাখার সদস্য অধ্যক্ষ মুকুল কুমার মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে তাহলে ভোটের মাঠে তেমন আমেজ থাকবে না। তবে বিএনপি না এলেও আওয়ামী লীগের কেউ যদি স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহী প্রার্থী হন, তবে তাঁর সঙ্গেই ক্ষমতাসীন দলের লড়াই হবে। অথবা জাতীয় পার্টির প্রার্থীর সঙ্গে লড়াই হতে পারে। তবে ভোটে যারাই আসুন, তাঁদের চাওয়া একটি সুষ্ঠু নির্বাচন।