আমিরুল ইসলাম (৪০) ছিলেন পুরো পরিবারের ভরসা। তাঁর উপার্জনেই চলত সংসার। একটি মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করার পাশাপাশি ভ্যানে করে ফল বিক্রি করতেন। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিয়ে একটি গুলিতে থেমে গেছে তাঁর জীবন। চার দিন পর স্বজনেরা হাসপাতালের মর্গে লাশের খোঁজ পান। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পুরো পরিবার এখন দিশাহারা।
আমিরুল ইসলাম ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ছলিমপুর গ্রামের প্রয়াত জাফর আলীর ছেলে। খুব ছোটকালেই তাঁর মা–বাবা মারা যান। শ্বশুরের কোনো ছেলে না থাকায় ঘরজামাই থাকার শর্তে ১৫ বছর আগে বিয়ে করেছিলেন পাশের উপজেলা ফুলবাড়িয়ার মেয়ে তানজিনা আক্তারকে। তানজিনা ওই উপজেলার রাধাকানাই ইউনিয়নের শান্তিনগর গ্রামের সোহরাব আলীর মেয়ে। আমিরুল-তানজিনা দম্পতির দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে তোয়ার বয়স চার বছর, মেজ তোষার বয়স আড়াই বছর ও ছেলে মোয়াজের বয়স দেড় বছর।
জীবিকার প্রয়োজনে আমিরুল থাকতেন রাজধানীর উত্তরার আজমপুর এলাকায়। সেখানে একটি মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করার পাশাপাশি রাস্তায় ভ্যানে করে ফল বিক্রি করতেন। স্ত্রী ও তিন শিশুসন্তানকে নিয়ে ছিল তাঁর সংসার। ৯ মাস আগে শ্বশুর সোহরাব আলী মারা যাওয়ার পর ওই পরিবারের দায়িত্বও পড়ে আমিরুলের কাঁধে। শাশুড়ি ও প্রতিবন্ধী এক শ্যালিকার দেখাশোনা করতে হতো তাঁকেই।
স্বজনেরা জানান, গত ১৮ জুলাই বেলা দুইটার দিকে শাশুড়ি আমেনা খাতুনের সঙ্গে কথা হয়েছিল আমিরুলের। বাড়ির মোটর নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মেরামতের জন্য মিস্ত্রি পাঠাতে বলেছিলেন। স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন। বিকেল পাঁচটার দিকে আরেকবার ফোন করেছিলেন আমিরুল। কিন্তু সেই ফোন কেউ ধরেননি। সেদিন রাত আটটার দিকে আমিরুলের মুঠোফোনে স্ত্রী-শাশুড়ি ফোন করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। পরদিনও আমিরুলের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়ায় পরিবারের দুশ্চিন্তা শুরু হয়। এর পরদিনও (২০ জুলাই) যোগাযোগ করতে পারছিলেন না স্বজনেরা। ২১ জুলাই কয়েকজন স্বজন উত্তরা আজমপুর এলাকায় গিয়ে আমিরুলের খোঁজ শুরু করেন। জানতে পারেন, ১৮ জুলাই গোলাগুলিতে অনেক মানুষ মারা গেছেন। ২২ জুলাই কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে গিয়ে তাঁরা খোঁজ পান, আমিরুলকে ওই হাসপাতালে মৃত ঘোষণা হয়েছিল অজ্ঞাতনামা হিসেবে। হাসপাতালে সংরক্ষিত ছবি দেখে আমিরুলকে চেনার পর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে লাশ পান স্বজনেরা। পরে ২২ আগস্ট রাতেই লাশ নেওয়া হয় শ্বশুরবাড়িতে। সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
আমিরুলের চাচাশ্বশুর আলী হোসেন বলেন, ‘মোবাইল বন্ধ থাকায় আমাদের সন্দেহ হয়। আজমপুর এলাকায় গিয়ে জানতে পারি, আন্দোলনে এখানে অনেক গোলাগুলি হয়েছে। আমিরুলও আন্দোলনে যায়। সেখানে তার বন্ধুরাও আমিরুলের খবর পাচ্ছিল না। হাসপাতাল ঘুরতে থাকি। কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে গিয়ে ছবি দেখে আমিরুলকে শনাক্ত করি। পরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে আমরা চার দিন পর লাশ পাই। বাড়িতে লাশ আনার পর দেখেছি, বাঁ চোখ দিয়ে একটি গুলি ঢুকে মাথার পেছন দিক দিয়ে বের হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে আমাদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছিল।’
শাশুড়ি আমেনা খাতুন বলেন, ‘ছেলের অভাব পূরণ করতে বড় মেয়ের জামাইকে নিয়ে এসেছিলাম। আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর মেয়ের জামাই ছিল ভরসা। এহন আমার সংসারে আর কোনো অভিভাবক রইল না। গুলিতে সব শেষ হয়ে গেছে। এহন কে দেখব তার এতিম শিশুদের।’
বাবা ও স্বামীকে হারিয়ে তানজিনা আক্তার দিশাহারা। তিন শিশুসন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে—এ দুশ্চিন্তায় তিনি দিন কাটাচ্ছেন। তানজিনা আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার তো কিছুই রইল না। সাগরে ভাসিয়ে চলে গেল স্বামী। এই আন্দোলন আমাকে বিধবা করল, তিন সন্তানকে এতিম করে দিল।’