রাজশাহী জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন ইয়াসির আরাফাত ওরফে সৈকত। গতকাল বৃহস্পতিবার যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ ও সাধারণ সম্পাদক মো. মাইনুল হোসেন খান নিখিলের যৌথ স্বাক্ষরে তিন বছরের জন্য এই কমিটি ঘোষণা করা হয়।
ইয়াসির আরাফাতের বাবা হাবিবুর রহমান ছিলেন রাজশাহী জেলা ফ্রিডম পার্টির সভাপতি। তিনি দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসন থেকে ফ্রিডম পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তাঁর ছেলের যুবলীগের এই পদ পাওয়া নিয়ে স্থানীয় যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
ইয়াসির আরাফাতের বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রিশিকুল ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ইয়াসির আরাফাতের বাবা হাবিবুর রহমান ১৯৮৮ সালের চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ও ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হাবিবুর রহমান ফ্রিডম পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগের পার্টির সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন কর্নেল ফারুক রহমান। প্রবীণ আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, এই সমাবেশে হাবিবুর রহমান তাঁর নির্বাচনী প্রতীক কুড়াল দিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এই নেতা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। পরে ২০০১ সালে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এমন অবস্থায় থেকেই ২০১৩ সালে মারা যান।
বাংলাদেশ ফ্রিডম পার্টি বাংলাদেশের নিবন্ধিত একটি রাজনৈতিক দল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে সামরিক বাহিনীর কিছু বিপথগামী কর্মকর্তার হাতে নৃশংস হত্যার শিকার হন। হত্যাকারী কিছু কর্মকর্তা ১৯৮৭ সালের ৩ আগস্ট এই দল প্রতিষ্ঠা করেন। দলের প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, যিনি ছিলেন এই হত্যার প্রধান হোতা। পরে এই হত্যা মামলায় ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি কর্নেল ফারুকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। ১৯৭৬ সালের ৩০ মে লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান লিখেছিলেন, ‘আমি মুজিব হত্যায় সহায়তা করেছি, পারলে আমার বিচার করুক।’
ইয়াসির আরাফাতের বাবা হাবিবুর রহমান ছিলেন রাজশাহী জেলা ফ্রিডম পার্টির সভাপতি। দলটির প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, যিনি ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার প্রধান হোতা।
হাবিবুর রহমানের সংসদ সদস্য প্রার্থী হওয়া এবং রাজনৈতিক পরিচয়ের বিষয়টি গোদাগাড়ী আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা বদরুজ্জামান রবু নিশ্চিত করেছেন। তিনি অসুস্থ থাকায় বেশি কথা বলতে পারেননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় আওয়ামী লীগের আরেক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, হাবিবুর রহমানের নির্বাচনী জনসভার বক্তব্য তিনি শুনেছেন। তিনি জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তব্য রাখতেন। ভোট বেশি পাননি, কিন্তু নির্বাচনী মাঠ শুধু বক্তব্য দিয়ে গরম করে ফেলেছিলেন।
গোদাগাড়ী উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমও হাবিবুর রহমানের ফ্রিডম পার্টি থেকে নির্বাচন করার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। হাবিবুর রহমানের ছেলে রাজশাহী জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আর কেন্দ্রীয়ভাবে নেতা নির্বাচন ব্যবস্থার একই অবস্থা। তিনি বলেন, ‘১৯৮৯ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্রলীগের সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছিলাম। ১৯৯৩ সালে সেক্রেটারি হয়েছি ভোটের মাধ্যমে। ১৯৯৭ সালে ছাত্রলীগের সেক্রেটারি হয়েছি ভোটের মাধ্যমে। ২০১৫ সালে উপজেলা যুবলীগের সভাপতি হলাম ভোটের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা করে। আর এখন ঘরে বসে থেকে নেতা হওয়া যায়। মাঠে যাঁর বিচরণ নেই, কেউ চেনে না, চিনত না, তাঁরাই নেতা।’
রাজশাহী জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আবু সালেহ বলেন, ‘এই সেক্রেটারির বাবা যে ফ্রিডম পার্টির নেতা ছিলেন, তা শুনেছেন, পত্রপত্রিকায় দেখেছি।’ এই বিষয়গুলো কেন্দ্রে জানানো হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যুবলীগের নীতিনির্ধারক যাঁরা, তাঁরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন না, রাখেন না। আমরা যে ১৭ বছর ধরে যুবলীগ করলাম, তার কোনো সম্মান পেলাম না।’
যুবলীগের নতুন কমিটিতে নিচের দিকে স্থান পাওয়া কয়েকজন নেতাও ইয়াসির আরাফাতের এই পদ পাওয়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা যুবলীগের নতুন সাধারণ সম্পাদক ইয়াসির আরাফাত প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বয়স কম, তিনি ২০০১ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। তাঁর বাবা ফ্রিডম পার্টি থেকে নির্বাচন করেছিলেন কি না, এ বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তবে তিনি জেলা যুবলীগের গত কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির (২০০৯-১৪) সদস্য ছিলেন, জেলা ছাত্রলীগের (২০০৩-০৯) সদস্য ছিলেন। সংগঠনের জন্য জেল-জুলুম ভোগ করেছেন।
এ ব্যাপারে যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ ও সাধারণ সম্পাদক মো. মাইনুল হোসেন খান নিখিলের বক্তব্য নেওয়ার জন্য মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা ফোন ধরেননি।
যুবলীগের নতুন নেতাদের মিষ্টিমুখ করিয়েছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। একটি ছবিতে ইয়াসির আরাফাতকেও মিষ্টিমুখ করাতে দেখা যাচ্ছে। তাঁর বাবার ব্যাপারে জানতে চাইলে মেয়র লিটন প্রথম আলোকে বলেন, এই বিষয় তিনি জানতেন না। হঠাৎ গতকাল (বৃহস্পতিবার) থেকে শুনছেন। ইয়াসির আরাফাত নেতা হওয়ার আগে একবারের জন্যও তাঁর কাছে আসেননি। তিনি সাধারণ সম্পাদক হচ্ছেন, এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। কোন লাইনে হলো, তিনি তা–ও বুঝতে পারছেন না। কেন্দ্রীয় নেতাদের তো তাঁর ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়ার প্রয়োজন ছিল।
সদ্য ঘোষিত কমিটির সভাপতি করা হয়েছে মাহমুদ হাসান ফয়সলকে। তিনি আগের কমিটিতে সহসভাপতি ছিলেন। ঘোষিত ১৯ সদস্যবিশিষ্ট এই আংশিক কমিটিতে আলমগীর হোসেন, জোবায়ের হাসান, মুজাহিদ হোসেন, আরিফুল ইসলাম, তছিকুল ইসলাম, ওয়াসিম রেজা, কাজী মোজাম্মেল হক ও জাহাঙ্গীর আলমকে সহসভাপতি; মোবারক হোসেন, সামাউন ইসলাম ও সেজানুর রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক; কামরুল ইসলাম, রফিকুজ্জামান, হাবিবুর রহমান, মেরাজুল ইসলাম ও ফয়সাল আহমেদকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে।
যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, জেলা যুবলীগের ১০১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটির মধ্যে ১৯ সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কমিটি কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। আংশিক কমিটিকে আগামী ৬০ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে কেন্দ্রে জমা দিতে বলা হয়েছে। গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর জেলা ও মহানগর যুবলীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।