‘মানুষ টেহার লাইগা পাগলের মতো দৌড়ায়, কামায় ভালাই, কিন্তু শান্তি আর পায় না’

৪০ বছরের বেশি সময় ধরে ফেরি করে পণ্য বিক্রি করেন লিজা বানু। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ সেন্ট্রাল ফেরিঘাট এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

দস্তার পাত্রে শর্ষে, কালিজিরা, তিল, মেথি, পাঁচফোড়নের মতো নানা পদের পণ্য সাজিয়ে শীতলক্ষ্যা পাড়ে বসে থাকেন লিজা বানু। নারায়ণগঞ্জের বন্দর ঘাট এলাকায় নিয়মিত চলাচলকারী অনেকেই তাঁর পরিচিত। বেচাবিক্রির ফাঁকে সময় পেলেই বয়সী মুখে হাসির রেখা টেনে পথচারীদের কুশল জানতে চান লিজা।

তবে লিজা বানুর মুখে এখন সেই চিরচেনা হাসি নেই। চোখমুখে ক্লান্তির ছাপ। সম্প্রতি এক বিকেলে এগিয়ে গিয়ে খবরাখবর জানতে চাইলে ক্লান্ত কণ্ঠে লিজা বানু উত্তর দেন, ‘ভালানারে বাপ। শইলডা খারাপ। মনডাও ভালা না।’ মন খারাপের কারণ জানতে চাইলে বিস্তর আলাপ জুড়ে দেন।

বয়সী শরীরে প্রায়ই জ্বর আসে, ঠান্ডা লাগে, শরীর দুর্বল। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসায় চশমা নিতে হয়েছে। ‘শহরের বড় ডাক্তার’ দেখিয়ে চশমা কিনে দিয়েছেন তাঁর বোনের ছেলে। লিজা জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর ছোট বোনের সংসারে থাকছেন। শীতলক্ষ্যার পূর্বপাড়ে নবীগঞ্জে বোনের ভাড়া বাসা। থাকার জন্য টাকা গুনতে হয় না। খাবার আর ওষুধ খরচের বাইরে তেমন কোনো খরচও নেই। কিন্তু কয়েক মাস ধরে সেই সামান্য টাকা আয় করতেই ঘাম ঝরছে তাঁর। এ নিয়েই মন খারাপ।

মা মরল, বাপ মরল। একে একে পাঁচ সন্তানের জন্ম দিলাম, সবগুলাই মরা। এরপর তো উনিও (স্বামী আলী হোসেন) আমারে ছাইড়া গেল।
লিজা বানু

লিজার কাছে পুরোনো দিনগুলোই ভালো ছিল। সে কথার ব্যাখ্যাও যোগ করেন, ‘যুদ্ধের পরে মানুষের হাতে টেকা আছিল না, কিন্তু মানুষের সম্পদ আছিল। মাছে ভরা খালবিল, বনজঙ্গলে গাছগাছালি, মানুষ আছিল কম। শাপলা, শালুক, শাক, লতাপাতা টোকাইয়া মানুষ যা খাইছে, এহন শহরের সাহেবরা টেহা দিয়া কিন্নাও ওই খানা পায় না। তহন খাওনে স্বাদ আছিল, মানুষে মানুষে মহব্বত আছিল। অসুস্থ হইছে কম। মানুষ খাইয়া না খাইয়া শান্তিতে আছিল। এহন সার দিতে দিতে সব খাওনের স্বাদ নষ্ট অইছে, গুণ নষ্ট অইছে। এমন অবস্থা অইছে যে পোলাপাইন জন্মের পর মার বোহের (মায়ের বুকের) দুধ পায় না। ডিব্বা (প্যাকেটজাত দুধ) কিন্না খাওয়ায়। রাস্তাঘাটে মানুষের ধাক্কায় চলন যায় না। মানুষ টেহার লাইগা পাগলের মতো দৌড়ায়। টেহাও কামায় ভালাই। কিন্তু শান্তি আর পায় না।’

চাঁদপুরের মতলবে জন্ম লিজা বানুর। তাঁর কাছে বয়সের হিসাব বলতে ‘গন্ডগোলের (মুক্তিযুদ্ধ) সময় সবই বুঝি’। গৃহস্থ পরিবারের মেয়ে। পুতুল খেলার বয়সেই সংসার পেতেছিলেন পাশের গ্রামের আলী হোসেনের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের পর গ্রামে খাবার জোটে না। কোনো এক শীতের রাতে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে মেঘনার বুকে নৌকা ভাসে। আলী হোসেনের সঙ্গে সেই নৌকায় চড়ে বসেন লিজা। তাঁদের সঙ্গী কাজের খোঁজে গ্রাম ছেড়ে আসা আরও কিছু অচেনা মুখ। নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরে আলী হোসেন শুরু করেন দিনমজুরের কাজ। লিজা তখন ঘর সামলান। এভাবে ভালোই চলছিল।

লিজা জানালেন, একদিন ভারী বোঝা বইতে গিয়ে তরুণ আলী হোসেনের ঘাড়ে ব্যথা হয়। যে ব্যথা নিয়ে দিনমজুরির কাজ করতে পারেন না আলী। শহরের কালির বাজার থেকে এটা–সেটা কিনে এনে নারায়ণগঞ্জ সেন্ট্রাল ফেরিঘাটে বিক্রি শুরু করেন। অসুস্থ স্বামীকে সহায়তা করতে লিজা বানুও ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসেন। স্বামী-স্ত্রীর পালা করে চলে পণ্য বেচাকেনার কাজ। তারপর কেটে গেছে ৪০ বছরেরও বেশি সময়।

জীবনে কখনো কারও কাছে মাথা নত করেননি লিজা বানু। বাকি জীবনটাও মাথা উঁচু করেই কাটিয়ে দিতে চান

পুরোনো দিনের কথা বলতে গিয়ে কিছুটা স্মৃতি কাতর হয়ে ওঠেন লিজা। এরই মধ্যে দুজন ক্রেতা ভিড় করেন। ১০০ গ্রামের দুই প্যাকেট কালিজিরা কিনতে গিয়ে ১০ টাকা কম দিতে চান। লিজা তাতে রাজি হন না। তিনি বলেন, ‘পুরান দিন বাঘে খাইছে। বাজারে সব জিনিসের দাম আগুনের মতো।’

আশির দশকের শুরুতে অন্তঃসত্ত্বা হন সদ্য কৈশোর পেরোনো লিজা। স্বামী-স্ত্রী সেই অনাগত সন্তান নিয়ে নতুন জীবনের স্বপ্ন বোনেন। সেই স্বপ্ন হোঁচট খায় সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর।

‘মরা, একটা মরা পোলা অইছিল। মা মরল, বাপ মরল। একে একে পাঁচ সন্তানের জন্ম দিলাম, সবগুলাই মরা। এরপর তো উনিও (আলী হোসেন) আমারে ছাইড়া গেল।’ যেন এক নিশ্বাসে শেষ করতে চাইলেন জীবনে ঘটে যাওয়া যন্ত্রণার সব উপাখ্যান। তারপর বুক ভরে নিশ্বাস টেনে লিজা বলেন, ‘স্বামী–সন্তান থাকলে কি আইজকা এই অসুস্থ শইল নিয়া পথের ধারে বইয়া থাকি?’

মানুষের শান্তি হারিয়ে গেল কেন—প্রশ্নের উত্তরে বৃদ্ধা উদাস ভঙ্গিতে বলেন, ‘নিজেরেই জিগান না। এই রাস্তার মানুষগো ধইরা জিগান। কেউ শান্তিতে নাই। মানুষ দিন রাইত কাম কইরা তিনবেলা খাওন পায় না, পোলাপাইন পড়াইতে পারে না, চিকিৎসা পায় না।’ এরপর নিজের জীবনকেই উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করান তিনি। বলেন, ‘আমার কথাই কই, করোনার আগে এমনও দিন গেছে ডেলি (প্রতিদিন) পাঁচ শ, ছয় শ টেহার কাম করছি। এহন কোনো কোনো দিন এক শ টেহাও হয় না। মানুষের কাম নাই, টেহা নাই। বাজারে গেলে মাথা নষ্ট অইয়া যায়। এরপরেও মানুষ কেমনে ভালা থাহে?’

কথা বলতে বলতে টুকটাক বেচাকেনা হয়। চলতি পথের পুরোনো মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধা খবরাখবর জানতে চান। ফিরে আসার আগে লিজা বানুর কাছে প্রশ্ন ছিল—বাকি জীবনে আর কী চাওয়ার আছে তাঁর?

লিজা বানুর সোজাসাপটা উত্তর, ‘কোনো দিন মাথা নোয়াই নাই। কারও কাছে হাত পাতি নাই। বাকি জীবন এই সম্মানডা নিয়া মাথা উঁচা কইরা বাঁচতে চাই।’ তারপর আবার যোগ করেন, ‘কিন্তু পরিস্থিতি ভয়ানক খারাপ অইতাছে। জীবনে তো আর কম হারাইলাম না। ডর লাগে, কোনদিন জানি এই সম্মানডাও হারাই, মাথাডানি নোয়ান লাগে (নত করতে হয়)।’