বন্দরপাড়া গ্রামের মধ্যভাগে ঝড়ে বিধ্বস্ত ঘরে দাঁড়িয়েছিলেন শুঁটকিশ্রমিক আবুল কালাম। ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর বাঁশ ও ত্রিপলের ছাউনির ঘরটি ধসে গেছে। নতুন করে ঘর তৈরির জন্য বেশ কিছু বাঁশ ও ত্রিপল দরকার। কিন্তু এলাকার কোথাও বাঁশ পাওয়া যাচ্ছে না। সাত কিলোমিটার দূরে শহরে বাঁশ পাওয়া গেলেও দাম অনেক বেশি। বাঁশ কেনার টাকাও এখন তাঁর হাতে নেই।
আবুল কালাম বলেন, ‘ঝড়ের পর একরকম না খেয়েই আছি। মাথার ওপর কী দিয়ে ছাদ দেব, এখন সেই চিন্তাই করতেছি। হাতে টাকা নেই যে বাজারে গিয়ে বাঁশ ও ত্রিপল কিনতে পারব, জানি না কী হবে।’
ঘূর্ণিঝড় হামুনের তাণ্ডবে কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের বন্দরপাড়া লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। এই গ্রামের পাঁচ শ পরিবারের সব সদস্যের অবস্থাই আবুল কালামের মতো। সবাই শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষ। নাজিরারটেক উপকূলে গড়ে ওঠা ৭০০টির বেশি শুঁটকি মহালে শ্রমিক হিসেবে কিংবা শহরে রিকশা-টমটম চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তাঁরা।
কেবল বন্দরপাড়া নয়, পাশের নাজিরারটেক উপকূলের কুতুবদিয়াপাড়া, বাসিন্যাপাড়া, সমিতিপাড়াসহ আরও পাঁচটি গ্রামের এখন এ অবস্থা। ঝড়ে এসব গ্রামের কয়েক শ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত কারও হাতে সরকারি–বেসরকারি কোনো সহায়তা এসে পৌঁছায়নি।
গত মঙ্গলবার রাতের ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয় গ্রামগুলোর চার শতাধিক ঘরবাড়ি। ঝড়ে শত শত গাছ ভেঙে পড়েছে। সেসবের বেশির ভাগই এখনো সে অবস্থায় রয়েছে। ভেঙে পড়া গাছ সরানোর সময় পাচ্ছেন না এলাকার লোকজন। সবাই নিজেদের ঘর মেরামতে ব্যস্ত। অনেকেই পরিবার–পরিজন নিয়ে গতকাল বুধবার রাতও খোলা আকাশের নিচে কাটিয়েছেন।
ঘূর্ণিঝড়ের সময় নারকেলগাছ পড়ে বিধ্বস্ত হয় বন্দরপাড়ার শুঁটকিশ্রমিক নুরুল আলমের ঘর। আজ সকাল পর্যন্ত গাছ সরানো হয়নি। নুরুল আলম ( ৬৫) জানান, সবাই নিজের বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি সংস্কার নিয়ে ব্যস্ত, কোথাও গৃহনির্মাণ সামগ্রী মিলছে না। তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৫৫) জানান, রান্নাঘর বিধ্বস্ত হওয়ায় গতকাল দুপুর ও রাতের খাবার খাওয়া হয়নি তাঁদের। এখন পর্যন্ত ত্রাণসহায়তাও পাওয়া যায়নি।
পাশের বিধ্বস্ত ঘরটি রিকশার শ্রমিক দেলোয়ার হোসেনের। ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর ঘরটিও ধসে যায়। স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে তিনি খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন। দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, মঙ্গলবার রাতে যখন ঘূর্ণিঝড় হামুন আঘাত হানে, তখন তিনি শহরের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছিলেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে। গতকাল সকালে গ্রামে গিয়ে দেখেন ঘরের চিহ্নও নেই।
দেলোয়ার জানান, আজ সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত তাঁরা সরকারি–বেসরকারি উদ্যোগে কোনো ত্রাণসহায়তা পাননি। তাঁরা জরুরি ভিত্তিতে গৃহনির্মাণ সামগ্রী চান।
১ নম্বর ওয়ার্ডের ১২টি গ্রামে বসবাস করেন অন্তত ৬০ হাজার শ্রমজীবী মানুষ। শুঁটকি উৎপাদনের প্রায় ৭০০ মহাল নাজিরারটেক উপকূলে গড়ে উঠেছে। বেড়িবাঁধ না থাকায় ঘূর্ণিঝড়ে সমুদ্রের পানিতে প্লাবিত হয় এই ওয়ার্ডের ঘরবাড়ি।
পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আকতার কামাল বলেছেন, ঘূর্ণিঝড়ে এই ওয়ার্ডে অন্তত ৩০০ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও কয়েক শ। ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি কিছু পরিবারকে নগদ সহায়তা দিয়েছেন। কিন্তু সরকারি–বেসরকারি উদ্যোগে আজ সকাল পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে ত্রাণসহায়তা পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। বৃষ্টি শুরু হলে খোলা আকাশের নিচে থাকা লোকজনের দুর্ভোগ বাড়বে।
পৌরসভার মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, ১ নম্বর ওয়ার্ডের বন্দরপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়াসহ অন্য এলাকাতে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত ২০০ পরিবারে ঢেউটিন এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেড় হাজার পরিবারে ত্রাণসহায়তা দেওয়া হবে। আজ দুপুরে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এ সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হবে।
মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরী আরও বলেছেন, ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত পৌরসভার ১, ২ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। এসব ওয়ার্ডে অন্তত ১৫ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। অন্য ৯টি ওয়ার্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও কয়েক হাজার ঘরবাড়ি ও দোকানপাট। ওয়ার্ডভিত্তিক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে তাঁদের মধ্যে ত্রাণসহায়তা পৌঁছে দেওয়া হবে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে ঘূর্ণিঝড় হামুন কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে। রাত ১০টার আগেই কক্সবাজার শহর লন্ডভন্ড হয়ে পড়ে। রাত ৯টার পর আঘাত হানে জেলার সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া, মহেশখালী এবং উপকূলীয় উপজেলা পেকুয়া ও চকরিয়ায়। জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, সব মিলিয়ে কক্সবাজার পৌরসভা, সদর উপজেলা, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া ও চকরিয়ায় ৪০ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েক কিলোমিটার বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে, উপড়ে পড়েছে হাজার হাজার গাছপালা ও অসংখ্য বিদ্যুতের খুঁটি।
জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেছেন, দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ত্রাণসহায়তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি নির্মাণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে বরাদ্দ দেওয়া হবে ঢেউটিনসহ গৃহনির্মাণ সামগ্রী।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য ১১৭ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আজ বিকেলের মধ্যে এই সহায়তা পৌঁছানোর চেষ্টা চলছে। কক্সবাজার সদর উপজেলায় ১০ টন, পেকুয়ায় ১৪ টন, চকরিয়ায় ১০ টন, মহেশখালীতে ২৫ টন, কুতুবদিয়ায় ২০ টন ও কক্সবাজার পৌরসভায় ১০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ করা চাল স্থানীয় খাদ্যগুদাম থেকে উত্তোলনের কথা রয়েছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, ঘূর্ণিঝড়ে জেলায় তিনজন নিহত হয়েছেন। তাঁরা হলেন—কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী এলাকার আবদুল খালেক ( ৪২), মহেশখালীর উপজেলার বড় মহেশখালী ইউনিয়নের গোরস্তান পাড়ার হারাধন দে ( ৪৫) ও চকরিয়া উপজেলার বদরখালী গ্রামের আশকার আলী (৪৫)। ঘরের দেয়াল চাপা পড়ে মঙ্গলবার রাত ৯টায় আবদুল খালেক এবং রাতে গাছচাপায় অন্য ২ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন অন্তত ৬০ জন।
গতকাল রাত আটটার দিকে কক্সবাজার শহরের হোটেল–মোটেল জোন, ঝাউতলা, লালদীঘির পাড়, জেলা প্রশাসন ও আদালত ভবন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হলেও শহরের অর্ধেক অংশ এখনো অন্ধকারে। জেলার সাগরদ্বীপ মহেশখালী, কুতুবদিয়াতে আজ সকাল ১০টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ পুনঃস্থাপন সম্ভব হয়নি। তাতে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘসময় ধরে বিদ্যুৎ না থাকায় মুঠোফোনও কাজ করছে না। ঘরের ফ্রিজে রাখা মাছ, মাংস ও তরকারি নষ্ট হয়েছে অনেকের।
শহরের বিভিন্ন সড়কে বিদ্যুতের তার ও ট্রান্সফরমার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব সংস্কার করতে আরও কিছুটা সময় লেগে যেতে পারে জানিয়ে কক্সবাজার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল কাদের গণি বলেছেন, গতকাল রাতে শহরে অধিকাংশ অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। আজ সন্ধ্যা নাগাদ বাকি অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার কাজ চলছে।