বনের ঠিকানায় ফিরেছে নীলা ও নিশাত

বনে অবমুক্ত করার আগে মৌলভীবাজারের জানকীছড়া বন্য প্রাণী উদ্ধার কেন্দ্রে থাকা লজ্জাবতী বানর
ছবি: প্রথম আলো

নীলা এসেছিল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে। আর নিশাত গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে। প্রায় আট মাস তারা ছিল মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জানকী ছড়া বন্য প্রাণী উদ্ধার কেন্দ্রে। মানুষের সেবাযত্নে এত দিন তাদের সময় একরকম কেটেছে। তবে বনের প্রাণীকে তো শেষ পর্যন্ত বনে ফেরত পাঠাতে হবে। তাই শেষ পর্যন্ত সংকটাপন্ন প্রজাতির প্রাণী হিসেবে তাদের ঠিকানা হলো বনে।

নীলা ও নিশাত নামের এই লজ্জাবতী বানর দুটিকে বৃহস্পতিবার রাতে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে অবমুক্ত করে দেওয়া হয়। বনের মধ্যে গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে এ সময় তাদের গলায় পরানো হয়েছে ট্র্যাকিং ডিভাইস বা কলারিং। এর আগে অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর শরীরে ট্র্যাকিং ডিভাইস ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু বানর গোত্রীয় প্রাণীদের শরীরে এটাই প্রথম।

লাউয়াছড়া বনে অবমুক্ত করার পর লজ্জাবতী বানরগুলো ওই বনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে কি না এবং বনের স্থায়ী বাসিন্দাদের সঙ্গে কোনো প্রকার দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছে কি না, তা জানা এই গবেষণার অন্যতম উদ্দেশ্য।
হাসান-আল রাজী, গবেষণা প্রকল্পের পরিচালক

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের মৌলভীবাজারে অবস্থিত বিভাগীয় কার্যালয়, বন্য প্রাণী গবেষক ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা প্লামপ্লরিস ইভি সূত্রে জানা গেছে, নীলা নামের লজ্জাবতী বানরটিকে গত বছরের ১৬ মে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। আর নিশাত নামের বানরটিকে গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে গত বছরের ৩০ মে উদ্ধার করা হয়। দুটিই স্ত্রী প্রজাতির বানর এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল। উদ্ধারের পর তাদের জানকী ছড়া বন্য প্রাণী উদ্ধার কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়। সেখানে তাদের এই নামকরণ করা হয়েছিল। উদ্ধারের সময় নীলার ওজন ছিল ৭৬০ গ্রাম। ছাড়ার সময় ওজন হয়েছে ৯৪৫ গ্রাম। নিশাতকে উদ্ধারের সময় ওজন ছিল ৭০৫ গ্রাম। লাউয়াছড়ায় অবমুক্তের সময় তার ওজন ছিল ৮৬৫ গ্রাম। উদ্ধারের সময় তাদের শুধু ওজনই কম ছিল না, শারীরিকভাবেও তারা দুর্বল ছিল। ছাড়ার সময় দুটিই প্রাপ্তবয়স্ক ও শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল।

গবেষণা সংস্থা প্লামপ্লরিস ইভি সূত্রে জানা গেছে, বন বিভাগের সহযোগিতা ও জার্মানভিত্তিক দাতা সংস্থা প্লামপ্লরিস ইভির অর্থায়নে লজ্জাবতী বানর নিয়ে গবেষণা ও সংরক্ষণের কাজ হচ্ছে। এই কাজের অংশ হিসেবে দুটি লজ্জাবতী বানরকে লাউয়াছড়া বনে অবমুক্ত করা হয়। দুটি বানরের গলায় যুক্ত করা হয়েছে ট্র্যাকিং ডিভাইস। এর আগে অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর শরীরেও ট্র্যাকিং ডিভাইস ব্যবহার করা হয়েছে। বানর গোত্রীয় প্রাণীদের দেহে এটাই প্রথম। আর গবেষণা কার্যক্রমটি তদারক করছেন বাংলাদেশের বন্য প্রাণী গবেষক দম্পতি হাসান-আল রাজী ও মার্জান মারিয়া। ট্র্যাকিং ডিভাইসের মাধ্যমে বনের ভেতরে এই দুটি লজ্জাবতী বানরকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা এবং খুঁজে বের করা সম্ভব হবে।

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) লজ্জাবতী বানরকে সংকটাপন্ন প্রাণী হিসেবে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। লজ্জাবতী বানর লাজুক বানর নামেও পরিচিত। এটি দেশের ক্ষুদ্রতম বানর-জাতীয় প্রাণী।

গবেষণা প্রকল্পের পরিচালক হাসান-আল রাজী রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘লাউয়াছড়া বনে অবমুক্ত করার পর লজ্জাবতী বানরগুলো ওই বনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে কি না এবং বনের স্থায়ী বাসিন্দাদের সঙ্গে কোনো প্রকার দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছে কি না, তা জানা এই গবেষণার অন্যতম উদ্দেশ্য। এ ছাড়া এক এলাকা থেকে উদ্ধার করা বানর অন্য এলাকায় ট্র্যাকিং ডিভাইস লাগিয়ে ছাড়া হবে। কারণ, এতে জানা যাবে, নতুন পরিবেশে তারা কীভাবে টিকে থাকছে বা অন্য বানরগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক কেমন। তাদের খাবার, প্রজননসহ অন্যান্য বিষয়ও জানা যাবে।’

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) লজ্জাবতী বানরকে সংকটাপন্ন প্রাণী হিসেবে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। লজ্জাবতী বানর লাজুক বানর নামেও পরিচিত। এটি দেশের ক্ষুদ্রতম বানর-জাতীয় প্রাণী। এরা বাংলাদেশে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের চিরসবুজ বনের বাসিন্দা এবং নিশাচর। বনের গভীরে উঁচু গাছে থাকতে পছন্দ করে। দিনে গাছের খোঁড়লে বা ঘন পাতার আড়ালে ঘুমিয়ে কাটায়। ঘুমালে শরীর গোল বলের মতো করে রাখে। বিরল, নিশাচর ও লাজুক হওয়ায় দিনে এদের সহজে চোখে পড়ে না। এগুলো গাছে গাছেই থাকে। সহজে মাটিতে নামে না। ধীরগতিতে চলাফেরা করে। এরা সাধারণত ফল, পাতা, উদ্ভিদের কষ বা নির্যাস খায়। মাঝেমধ্যে বড় কীটপতঙ্গ, পাখির ডিম-ছানা, সরীসৃপও খেয়ে থাকে।

প্রায় দুই বছর ধরে মৌলভীবাজার বন বিভাগ ও প্লামপ্লরিস ই ভি যৌথভাবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অসুস্থ কিংবা পাচারের পথ থেকে উদ্ধার হওয়া লজ্জাবতী বানরকে জানকী ছড়া বন্য প্রাণী উদ্ধার কেন্দ্রে রেখে সেবা-শুশ্রূষা করছে।
মো. রেজাউল করিম চৌধুরী, বন কর্মকর্তা, সিলেট

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘প্রায় দুই বছর ধরে মৌলভীবাজার বন বিভাগ ও প্লামপ্লরিস ই ভি যৌথভাবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অসুস্থ কিংবা পাচারের পথ থেকে উদ্ধার হওয়া লজ্জাবতী বানরকে জানকী ছড়া বন্য প্রাণী উদ্ধার কেন্দ্রে রেখে সেবা-শুশ্রূষা করছে। লজ্জাবতী বানরকে তাদের নিজস্ব উপযুক্ত আবাসস্থলে আবার ছেড়ে দেওয়ার কাজ করছে। জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়ার আগে প্রাণীদের গলায় রেডিও কলার সেট করে দেওয়া হচ্ছে। এতে ওরা পরবর্তী সময়ে কখন কোন দিকে কী অবস্থায় থাকছে, তা আমরা মনিটর করতে পারছি।’