দর্শনা থেকে রাজশাহী যাচ্ছিলেন এক অন্তঃসত্ত্বা নারী। চলন্ত ট্রেনেই হঠাৎ তাঁর প্রসববেদনা ওঠে। দিশাহারা হয়ে পড়েন সঙ্গে থাকা তাঁর স্বজনেরা। রেলের কর্মীরা বিষয়টি জানতে পেরে মাইকিং করতে থাকেন। ট্রেনে কোনো চিকিৎসক আছেন কি না জানতে চান। মাইকিং শুনে এগিয়ে আসেন এক চিকিৎসক। মুহূর্তে চলন্ত ট্রেনের বগি হয়ে যায় হাসপাতালের কক্ষ। সুস্থভাবে ওই নারী জন্ম দেন ফুটফুটে এক সন্তান।
আজ সোমবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে খুলনা থেকে রাজশাহীগামী আন্তনগর কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস ট্রেনের ‘ঙ’ নম্বর বগিতে এ ঘটনা ঘটে। ট্রেনটি তখন পাবনার ঈশ্বরদী জংশন স্টেশন এলাকায় অবস্থান করছিল।
ট্রেনে সন্তান জন্ম দেওয়া ওই নারীর নাম স্বর্ণা আক্তার (২০)। তিনি ঝিনাইদহের মহেশপুরের পান্থপাড়া ইউনিয়নের ঘুগরী গ্রামের ইয়াসিন আরাফাতের স্ত্রী। তাঁর স্বামী প্রবাসে রয়েছেন। দেবর ও দুজন আত্মীয়ের সঙ্গে তিনি দর্শনা থেকে রাজশাহী যাচ্ছিলেন। ট্রেনটি রাজশাহীতে পৌঁছার পর আগে থেকেই রাজশাহী স্টেশনে অপেক্ষায় থাকা বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার মা ও নবজাতককে উপহার দিয়ে বরণ করেন। পরে মা ও নবজাতককে রাজশাহীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস ট্রেনের দায়িত্বরত গার্ড ইলিয়াস কবীর জানান, সকালে ট্রেনটি খুলনা থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে যাত্রা করে। সকাল সোয়া ৯টার দিকে দর্শনা স্টেশনে পৌঁছালে ওই অন্তঃসত্ত্বা নারী তাঁর স্বজনদের সঙ্গে ট্রেনের ‘ঙ’ বগিতে ওঠেন। বেলা পৌনে ১১টার দিকে ট্রেনটি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা স্টেশনে পৌঁছায়। এ সময় ওই নারীর প্রসববেদনা ওঠে। তিনি ট্রেনের মধ্যে ব্যথায় চিৎকার করতে থাকেন। এতে সঙ্গে থাকা স্বজনেরা দিশাহারা হয়ে পড়েন। ট্রেনের অন্য যাত্রীরাও ওই নারীর সাহায্যে ছোটাছুটি শুরু করেন। বিষয়টি ট্রেনের গার্ড তাপস কুমার দেকে জানানো হয়। পরে তিনি মাইকিং শুরু করেন। ট্রেনে কোনো চিকিৎসক থাকলে ‘ঙ’ বগিতে যাওয়ার অনুরোধ জানান। মাইকিং শুনে ট্রেনে থাকা ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের নবজাতক ও শিশুবিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নাজনীন আক্তার ‘ঙ’ বগিতে ছুটে আসেন। তিনি দ্রুত কাপড় দিয়ে ওই নারীকে ঘিরে ফেলতে বলেন। এ সময় ট্রেনে থাকা অন্য নারীরা শাড়ি বের করে ট্রেনের তিনটি আসন ঘিরে ফেলেন এবং সেখানে নারী যাত্রীদের রেখে সব পুরুষ যাত্রীকে সরিয়ে দেন। চিকিৎসক চেষ্টা করতে করতেই ট্রেন ঈশ্বরদী স্টেশনে চলে আসে। তখন চিকিৎসক বলেন, তাঁর গ্লাভস লাগবে। তিনি ওই নারীর দেবরকে দিয়ে দোকান থেকে গ্লাভস আনার ব্যবস্থা করেন। গ্লাভস এনে দেওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বেলা ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে ওই চিকিৎসকের সহযোগিতায় স্বর্ণা আক্তার ফুটফুটে এক ছেলেসন্তানের জন্ম দেন। পুরো ট্রেনে তখন স্বস্তি ফিরে আসে।
গার্ড ইলিয়াস কবীর আরও জানান, এরপর চিকিৎসক বলেন, এখন রক্তক্ষরণ হতে পারে। এই মাকে ঈশ্বরদীতে নামিয়ে দিলে ভালো হয়। কিন্তু ওই মা বলেন, তিনি ঠিক আছেন। তাঁকে রাজশাহীতে পাঠালেই ভালো হয়। বিষয়টি তিনি তৎক্ষণাৎ মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদারকে জানান। তিনি রেলওয়ের অ্যাম্বুলেন্স, চিকিৎসক ও উপহারসামগ্রী নিয়ে রাজশাহী রেলস্টেশনে অপেক্ষায় ছিলেন। রাজশাহী স্টেশনে নামার পর মা ও নবজাতককে উপহার দিয়ে বরণ করে নেন। পরে তাঁদের শহরের একটি ভালো ক্লিনিকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
শিশুটি জন্মের পর চিকিৎসক নাজনীন আক্তার জানান, তিনি রাজশাহীতেই যাচ্ছিলেন। মাইকিং শুনে ছুটে আসেন। ওই নারীর অবস্থা তখন ভালো ছিল না। তিনি ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। তবে খুব দ্রুতই স্বাভাবিকভাবে নবজাতকটি ভূমিষ্ঠ হয়েছে। মা ও শিশু দুজনই সুস্থ আছে।
রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার জানান, ওই নারীকে রাজশাহীতেই একটি ক্লিনিকে আনা হচ্ছিল সন্তান প্রসবের জন্য। সঙ্গে কয়েকজন নারী ও এক দেবর ছিলেন। আসার পথে ট্রেনের ভেতরে তিনি সন্তান প্রসব করেছেন। তাঁরা যে ক্লিনিকে যেতেন, রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছার পর অ্যাম্বুলেন্সে করে সেখানে পাঠানো হয়েছে। চিকিৎসক জানিয়েছেন, মা ও নবজাতক সুস্থ রয়েছে।