খুলনায় তিনবারের ইউপি চেয়ারম্যানকে হত্যা করল কারা

নিহত ইউপি চেয়ারম্যান শেখ রবিউল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

৪২ বছর বয়সের মধ্যে পরপর তিনবার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। শেষ দুবার আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিপক্ষে প্রার্থী হয়ে জয়ী হয়েছেন। গতকাল শনিবার রাতে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শরফপুর ইউপির সেই চেয়ারম্যান শেখ রবিউল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। কারা, কেন ও কী কারণে তাঁকে হত্যা করেছে, সেটা নিয়েই এখন আলোচনা চলছে।

রবিউলকে হত্যা করার মতো কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না কেউ। তবে নিহত চেয়ারম্যানের এলাকার লোকজনের সন্দেহ, এবারের উপজেলা নির্বাচন নিয়ে হয়তো কারও সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিল।

এ ঘটনায় আজ রোববার দুপুর পর্যন্ত কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। ঘটনার কারণও উদ্‌ঘাটন করতে পারেনি। তবে এ বিষয়ে তদন্ত ও অনুসন্ধান চলছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

রবিউল ইসলাম ডুমুরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। একসময় তিনি শরফপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। গতকাল শনিবার বিকেলে ডুমুরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভা ছিল উপজেলার শহীদ জোবায়েদ আলী মিলনায়তনে। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন ভূমিমন্ত্রী ও খুলনা-৫ আসনের (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। রবিউল ইসলাম ওই বর্ধিত সভায় যোগ দিয়েছিলেন।

ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত রবিউল ইসলাম। মন্ত্রী এলাকায় থাকা অবস্থায় তাঁরই এলাকায় তাঁরই ঘনিষ্ঠজনকে গুলি করে হত্যা করার ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। একসময় ‘সন্ত্রাসের জনপদ’ হিসেবে পরিচিত ডুমুরিয়া উপজেলায় আবার টার্গেট কিলিং (পরিকল্পিত হত্যা) ফিরে এসেছে কি না, সেই আলোচনাও করছেন স্থানীয়দের অনেকে।

ডুমুরিয়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও যুবলীগের আহ্বায়ক গোবিন্দ ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার বিকেল পাঁচটায় বিশেষ বর্ধিত সভা শুরু হয়। সাড়ে সাতটার দিকে শেষ হয় সেই সভা। সভা শেষে রবিউল ইসলাম আরও কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে বাজারে বসে আড্ডা দেন। এরপর খুলনায় যাওয়ার পথে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের গুটুদিয়া এলাকায় দুর্বৃত্তের গুলিতে তিনি নিহত হন।

এ বিষয়ে ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ প্রথম আলোকে বলেন, চেয়ারম্যান রবিউল ইসলামের হত্যাকাণ্ড জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। একসময়ের আতঙ্কের উপজেলা হিসেবে পরিচিত হলেও গত প্রায় ২২ বছরে এ ধরনের কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি। ওই সময় যাঁরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করতেন, তাঁরা এখন ছদ্মবেশে এলাকায় আছেন।

চেয়ারম্যান রবিউল ইসলামের আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনবারের চেয়ারম্যান হলেও খুবই সাধারণ জীবনযাপন করতেন রবিউল। তাঁর বাড়ি শরফপুর ইউনিয়নের ভুলবাড়িয়া গ্রামে। তবে পরিবার নিয়ে থাকতেন খুলনা নগরের নিরালা আবাসিক এলাকায়। তাঁর স্ত্রী সমাজসেবা অধিদপ্তর খুলনায় চাকরি করেন। ৮ ও দেড় বছরের দুটি ছেলে আছেন তাঁদের। রবিউল দুই ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে ষষ্ঠ।

পরিবারের লোকজন বলেন, রবিউল ইসলাম মোটরসাইকেলে করে একাই চলাফেরা করতেন। প্রতিদিন সকালে ডুমুরিয়ায় নিজের এলাকায় যেতেন আর রাতে খুলনায় ফিরে আসতেন। গতকালও রাত ১০টার দিকে ডুমুরিয়া থেকে খুলনার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিলেন রবিউল। গুটুদিয়ার ওয়াপদা বাঁধের কাছে আসার পর সন্ত্রাসীরা তাঁকে গুলি করে পালিয়ে যান। গুলির শব্দ শুনে স্থানীয় লোকজন ছুটে এসে তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে ডুমুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।

ওই সময় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন চিকিৎসক কনক হোসেন। তিনি বলেন, রাত সাড়ে ১০টার দিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রবিউল ইসলামকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনি দেখেন, হাসপাতালে আনার বেশ আগেই মারা গেছেন তিনি। রবিউলের পিঠের নিচের অংশে গুলি করা হয়েছে। তবে কতটি গুলি করা হয়েছে, তা ময়নাতদন্ত ছাড়া বলা যাবে না।

আজ রোববার সকাল ১০টার দিকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ময়নাতদন্তের জন্য রবিউলের লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে লাশকাটা ঘরে। ওই ঘরের সামনে মানুষের ভিড়। সবার মুখেই একই কথা, কেন হত্যা করা হলো রবিউল ইসলামকে?

জি এম আতিয়ার রহমানের বাড়ি রবিউল ইসলামের বাড়ির পাশেই। তিনি বলেন, রবিউলকে হত্যা করার মতো তাঁর কোনো শত্রু নেই। এলাকায় সাধারণ মানুষের কাছেও তিনি জনপ্রিয়। তাঁকে কেউ মেরে ফেলতে পারে, এমনটি হয়তো কখনো তিনি ভাবেননি। এ কারণেই তিনি সব সময় একা মোটরসাইকেল নিয়ে ঘোরাফেরা করতেন। তাঁকে কারা, কেন হত্যা করল; তা কেউ বুঝে উঠতে পারছেন না।

ডুমুরিয়া উপজেলাটি পড়েছে খুলনা জেলা পুলিশের বি-সার্কেলের মধ্যে। ওই সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আসিফ ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, যেহেতু কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই, তাই কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে পুরো ঘটনাটি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে।