৮০ বছর ধরে শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজ পড়েন মনসুরুদ্দিন

৮০ বছর ধরে শোলাকিয়ায় নামাজ আদায় করেন মনসুরুদ্দিন হাজী
ছবি: প্রথম আলো

নাম মো. মনসুরুদ্দিন হাজী। বয়স তাঁর ৯২ বছর। এখনো বেশ সুস্থ-সবল। নিজে নিজে চলাফেরা করতে পারেন। কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে ঈদের নামাজ পড়ার অভিজ্ঞতা তাঁর বহু বছরের। মনসুরুদ্দিনের দাবি, তাঁর বয়স যখন ১২ বছর তখন বাবার হাত ধরে হাওর-অধ্যুষিত ইটনা উপজেলা সদর থেকে প্রথমে কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করতে এসেছিলেন। সেই থেকে ৮০ বছর ধরে এই মাঠে নামাজ আদায় করে আসছেন।

গত সোমবার শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে কথা হয় মনসুরুদ্দিন হাজীর সঙ্গে। কবে থেকে এ মাঠে নামাজ আদায় করেন, জিজ্ঞাসা করতেই তিনি অনেকটা স্মৃতিকাতর হয়ে যান। বলেন, ‘সেই ১২ বছর বয়সে ইটনা হাওর থেকে নদীপথে এসে বাবার হাত ধরে নামাজ পড়তে এসেছিলাম। তখন হয়বতনগর দেওয়ান বাড়ির জমিদাররাসহ ইটনার জমিদারেরা নামাজ পড়তে আসতেন। ৮০ বছর থেকে আমি এ মাঠে নামাজ আদায় করছি। সেই থেকে দেখছি এ মাঠ মুসল্লিতে ভরপুর হয়ে যায়। তবে দিন দিন মুসল্লির সংখ্যা বেড়ে মাঠ ছাড়িয়ে আশপাশের রাস্তাঘাটসহ বাড়িতে চলে গেলেও দীর্ঘদিন ধরে মাঠের জায়গা বাড়েনি।’

শোলাকিয়া এলাকার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. মাজহারুল হক। প্রায় ৪৫ বছর ধরে নিয়মিত ঈদুল ফিতরের নামাজ এই মাঠে আদায় করেন তিনি। মাজহারুল বলেন, ‘জন্মের পর থেকেই আমরা এ মাঠে বিপুলসংখ্যক মুসল্লির উপস্থিতি দেখে আসছি। বাপ-দাদার কাছে শুনেছি এ মাঠ জমিদারদের মাঠ। জমিদাররা এ মাঠে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন।’

শোলাকিয়া এলাকার আরেক বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সী আবদুর রহিম প্রথমবার এ মাঠে কবে ঈদের নামাজ আদায়ের করেছেন, তা তাঁর মনে নেই। তিনি বলেন, ‘জন্মের পর থেকেই আমরা এ মাঠে বিপুলসংখ্যক মুসল্লির উপস্থিতি দেখে আসছি।’

শোলাকিয়া মাঠের ইতিহাস

কিশোরগঞ্জের ইতিহাস নিয়ে লেখা বিভিন্ন বই এবং স্থানীয় কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ধর্ম প্রচারের জন্য দেশের বাইরে থেকে এ দেশে আসা সৈয়দ আহাম্মদ (রহ.) নামের এক বুজুর্গ প্রথম এ মাঠে ঈদগাহ নামাজের ইমামতি করেন। তিনি ঈশা খাঁর বংশধর স্থানীয় হয়বতনগর দেওয়ান পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেওয়ানবাড়িতে থাকতেন। তখন থেকেই এ মাঠের প্রচলন ও প্রসার ঘটে। এ মাঠের ইতিহাস অনেক পুরোনো হলেও ১৯৫০ সালে দেওয়ান মান্নান দাদ খান সাড়ে ৩ একর জমি এ মাঠের নামে ওয়াক্ফ করে দেন। ১৮২৮ সালে শোলাকিয়ায় প্রথম ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ঈশা খাঁর ষষ্ঠ বংশধর দেওয়ান হয়বত খান কিশোরগঞ্জের জমিদারি প্রতিষ্ঠার পর এই ঈদগাহ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে জমির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পায়।

দেওয়ান মান্নান দাদ ছিলেন হয়বত খানের বংশধর। হয়বত খান ছিলেন বীর ঈশা খাঁর ষষ্ঠ অধস্তন পুরুষ। যে কারণে শুরু থেকে এ মাঠের জমিদারির একটা ঐতিহ্য রয়েছে। হয়বতনগর সাহেববাড়ির বাসিন্দা সৈয়দ আলী আজহারের লেখা ‘ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ’ বইয়ে ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ প্রতিষ্ঠার পেছনে হয়বতনগর জমিদারদের অকৃত্রিম অবদানের বিষয়টি উল্লেখ আছে।

বাবা-দাদার কাছ থেকে শোনা গল্পের বরাত দিয়ে স্থানীয় কয়েকজন প্রবীণ বলেন, ঈদের দিন জমিদারি ঐতিহ্যে ঘোড়ার গাড়িতে স্টেজ বানিয়ে তাঁর ওপর সিংহাসন বসিয়ে বাহিনী নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে শোলাকিয়া ঈদগাহে আসতেন জমিদারেরা। আসার পথে প্রজাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের মুদ্রা ছিটাতেন। এ ছাড়া ইটনা হাওরের জমিদারসহ বিভিন্ন এলাকার জমিদারেরা নানা রকমের নৌকায় করে এ ঈদগাহে নামাজ পড়তে আসতেন। জমিদারদের এসব তুলকালাম কাণ্ড আর স্বয়ং জমিদারদের সঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন বলে দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য লোকজন শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে নামাজ আদায় করতে আসতেন। ঈদের আনন্দের পাশাপাশি আগত মুসল্লিদের জন্য এটা ছিল বাড়তি একটা আকর্ষণ। এভাবেই এ মাঠের ঐতিহ্য গড়ে ওঠে। এ ছাড়া মাঠটি ছিল ওই এলাকার তৎকালীন জমিদারদের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ।

জনশ্রুতি আছে, মুঘল আমলে এখানকার পরগনার রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল শ লাখ টাকা। মানে এক কোটি টাকা। কালের বিবর্তনে শ লাখ থেকে বর্তমান শোলাকিয়া হয়েছে। অন্য আরেকটি বিবরণে রয়েছে, ১৮২৮ সালে শোলাকিয়া ঈদগাহে সোয়া লাখ মুসল্লি একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করেন। সেই থেকে ঈদগাহটি একসময় শোয়ালাকিয়া ঈদগাহ মাঠ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। লেখক মু. আ. লতিফের লেখা ‘কিশোরগঞ্জের ইতিহাস-ঐতিহ্য’ বইয়েও এ দুটি বর্ণনা রয়েছে।

দেশের বৃহত্তম ঈদের জামাত আয়োজনে শোলাকিয়া ঈদগা মাঠের সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে। সম্প্রতি তোলা ছবি

বৃহত্তম জামাতের জন্য প্রস্তুত মাঠ

বরাবরের মতো এবারও দেশে ঈদুল ফিতরের বৃহত্তম জামাতের জন্য প্রস্তুত শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ। বন্দুকের গুলির আওয়াজের মাধ্যমে কাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় ১৯৭তম ঈদের জামাত শুরু হবে।

কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও ঈদগাহ পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, এবার শোলাকিয়ায় ১৯৭তম ঈদুল ফিতরের জামাত অনুষ্ঠিত হবে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মুসল্লিদের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে। মাঠ ও আশপাশে সাজানো হয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের বড় জামাত আয়োজনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ বলেন, মুসল্লিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চার স্তরের নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা হয়েছে। সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে মাঠের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। ধাতব বস্তু শনাক্তকরণ যন্ত্র (মেটাল ডিটেক্টর) দিয়ে তল্লাশি করে প্রত্যেক মুসল্লিকে মাঠে ঢোকানো হবে। ২০১৬ সালে শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর থেকে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য মাঠ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বিশেষ দুটি ট্রেন চালু থাকবে।