স্নাতকোত্তর শেষ করে সহপাঠীরা অনেকে ছুটছিলেন চাকরির পেছনে। হেমন্ত চন্দ্র বর্মণ সেদিকে যাননি। তিনি স্বপ্ন দেখতেন নিজে কিছু করার। মনে পড়ে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় সহকারী শিক্ষক মোজাফ্ফর স্যারের কথা। ওই শিক্ষক একদিন ক্লাসে বলেছিলেন, ‘গাছ মানুষের পরম বন্ধু। মানুষ মানুষকে ঠকালেও গাছ ঠকায় না। গাছ লাগালে পরিবেশ রক্ষা হয়। মানুষ হয় অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী।’ স্যারের এসব কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল হেমন্তের (৪৭)। একদিন নার্সারি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। দুই যুগ আগে নিজের ১০ শতক জমিতে একটি নার্সারি গড়ে তোলেন।
হেমন্তের সেই নার্সারি ও খামার বেড়ে এখন ৩৫ একরে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পুকুর, হাঁস, উন্নত জাতের ছাগল, গাভি ও কবুতরের খামার। সমন্বিত সেই খামার থেকে খরচ বাদে এখন তাঁর মাসে গড়ে আয় হচ্ছে আড়াই লাখ টাকা। খামারে কাজ করছেন ৩৫ জন শ্রমিক। তাঁর পথ ধরে গ্রামের আরও তিন শতাধিক বেকার নারী-পুরুষ পর্যায়ক্রমে নার্সারি গড়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। হেমন্ত বর্মণের হাওয়ায় বদলে যাওয়া এককালের অবহেলিত গ্রামটিকে মানুষ এখন ‘নার্সারি গ্রাম’ নামে চেনে।
গ্রামটির আসল নাম গোবরা। রংপুরের পীরগাছা উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে নিভৃত এক গ্রাম। কাঁচাপাকা পথ ধরে হেমন্তের বাড়ি যাওয়ার সময় বাগান আর অসংখ্য খামার চোখে পড়ে। প্রায় প্রতিটি বাড়ির আনাচকানাচে সর্বত্র গাছের চারা ও সবজির চাষ করা হয়েছে। উঠানে ও খামারে হাঁস-মুরগি, গোয়ালে গরু-ছাগল। বাড়ির পাশে রয়েছে পুকুর আর নার্সারি। ঘরের চালা, আঙিনাজুড়ে চোখে পড়ে শৌখিন বিভিন্ন জাতের কবুতর। গ্রামের প্রতিটি বাড়ি যেন ছোট-বড় একেকটি খামার।
হেমন্তের বাড়িতে ঢুকে মন জুড়িয়ে যায়। গাছে গাছে সাজানো লম্বা পথ পেরিয়ে তারপর একতলা পাকা বাড়ি। পথের দুই পাশে সবজি, ফুল, সুপারি আর নারকেলগাছের দৃষ্টিনন্দন সারি মন কাড়ে। দরজায় কড়া নাড়ামাত্রই বাড়ি থেকে একজন বেরিয়ে এসে পরিচয় দেন, তাঁর নাম হেমন্ত চন্দ্র বর্মণ। এরপর তিনি ৩৫ একর জমিতে গড়ে তোলা সমন্বিত খামারটি ঘুরে দেখানোর ফাঁকে নিজে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প শোনালেন।
হেমন্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সিরাজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, লেখাপড়া শেষ করে সবাই চাকরির পেছনে ছোটে। কিন্তু ইচ্ছা থাকলে সমন্বয় খামার করেও যে নিজের পাশাপাশি অন্যের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হেমন্ত চন্দ্র। প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে সব সময় তাঁকে সহযোগিতা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় গোবরাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গাছের দুটি চারা উপহার পেয়েছিলেন হেমন্ত। ওই সময় শিক্ষক মোজাফ্ফর হোসেনের কাছ থেকে গাছ রোপণের উপকারিতার কথা শুনেছিলেন। সেই থেকে টুকটাক গাছের চারা কিনে বাড়ি ও গ্রামের খোলা স্থানে রোপণ করতেন।
হেমন্ত বলেন, ‘মূলত ওই সময় থেকে গাছ লাগানোর প্রতি আমার ঝোঁক বাড়ে।’ বলে চলেন হেমন্ত, ‘১৯৯৯ সালে স্নাতকোত্তর পাস করার পর দেখলাম, সহপাঠী বন্ধুরা চাকরির পেছনে ছুটছেন। আমার এসব ভালো লাগত না। একদিন রাতে অনেক ভাবলাম। মনে পড়ল মোজাফ্ফর স্যারের সেই কথা। সিদ্ধান্ত নিলাম নার্সারির বাগান গড়ব। বাড়ির সামনে ১০ শতক পতিত জমিতে কাঁঠাল, পেয়ারা, পেঁপে, জলপাই, মেহগনিসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় সাত হাজার বীজ লাগিয়ে গড়ে তুললাম সেই বাগান। এতে খরচ হয় প্রায় দুই হাজার টাকা। এসব বীজ থেকে গজানো চারা বছর শেষে বিক্রি করে পাই প্রায় ১৫ হাজার টাকা।’
সেই থেকে শুরু। পরের বছর হেমন্ত ৩০ শতক জায়গায় ২০ হাজার বীজ লাগিয়ে চারা বিক্রি করেন ৬০ হাজার টাকার। এভাবে তিনি বাণিজ্যিক চারা উৎপাদনে লেগে পড়েন। চারা বিক্রির টাকায় একে একে ৩০ একর জমি কিনে পুরো জমিতেই নার্সারি গড়ে তুলেছেন। আগে পৈতৃক সূত্রে পেয়েছিলেন ৫ একর জমি। বিভিন্ন জাতের ফল, ফুলসহ বর্তমানে তাঁর নার্সারিতে প্রায় ৩০০ প্রজাতির চারা উৎপাদিত হচ্ছে। প্রতিদিন ৩৫-৪০ জন শ্রমিক বাগানে কাজ করেন। এই নার্সারির চারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন এসে ট্রাকে করে নিয়ে যান। অনলাইনেও বিক্রি হয় চারা। নার্সারি থেকেই প্রতিবছর ৯০ থেকে ৯২ লাখ টাকার চারা বিক্রি হচ্ছে বলে জানালেন হেমন্ত।
শুধু নার্সারি নয়, হেমন্ত দুই একর জমিতে পুকুর খনন করে ছয় বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের মাছ চাষ করছেন। এতে তাঁর বছরে আয় হচ্ছে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। হেমন্তের খামারে বিদেশি গাভি রয়েছে ১০টি। দিনে গড়ে ৫০ লিটার দুধ পান। গরুর খামার থেকে বছরে আয় হচ্ছে আরও দুই লাখ টাকা। এ ছাড়া তোতাপুরি, হরিয়ানা, বিটল, ক্রসসহ উন্নত জাতের ২০০ ছাগলের একটি খামার আছে তাঁর। এসব ছাগল বছরে দুবার বাচ্চা দেয়। এ খামার থেকে বছরে হেমন্ত আয় করছেন প্রায় ৫ লাখ টাকা।
হেমন্ত জানান, ঘরের ভেতরে গড়ে তোলা কবুতরের খামারে বর্তমানে ২০ জাতের প্রায় ৩০০ কবুতর আছে। যার বর্তমান বাজারমূল্য ৭-৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ফেনসি, রেসার, গিরিবাজ, সিরাজি ও বিউটি কবুতরের চাহিদা বেশি। বছরে কবুতর বিক্রি করেও প্রায় দেড় লাখ টাকা আয় করেন তিনি।
২০০৫ সালে হেমন্ত লালমনিরহাট সদর উপজেলার দুরাকুঠি গ্রামের সুবাস চন্দ্রের মেয়ে লতা রানীকে বিয়ে করেন। তাঁর এক ছেলে শান্ত চন্দ্র বর্মণ (১৫) ও আরেক ছেলে প্রান্ত চন্দ্র বর্মণ (৭) বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। হেমন্ত সব সময় মেতে থাকেন খামার নিয়ে। তিনি উপজেলা পর্যায়ে একাধিকবার শ্রেষ্ঠ খামারি হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১৫ সালে জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ নার্সারি উদ্যোক্তা হিসেবেও পুরস্কার পেয়েছিলেন।
খামার গড়ে নিজের সংসারে সচ্ছলতা আনার পাশাপাশি গ্রামের অন্যদের কথাও ভুলে যাননি হেমন্ত। তাঁদেরও পরামর্শ দিয়ে নার্সারি, ছাগল-গাভি পালনে উৎসাহিত এমনকি সহযোগিতাও করেছেন। তাঁর পরামর্শে গ্রামের তিন শতাধিক মানুষ নার্সারি, মাছ, গাভি, ছাগল ও কবুতর পালন করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। গ্রামের প্রতিটি বাড়ি এখন খামারে পরিণত হয়েছে। এসব খামারে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারখানেক মানুষের।
হেমন্তের দেখানো পথে ওই গ্রামের যুবক রেজওয়ানুল হক, ফারুক সরকার, পরিতোষ চক্রবর্তী, এনামুল হক, সামছুল ইসলাম, মফিজার রহমান, মাইদুল ইসলাম, সাইফুল ইসলামসহ অনেকে নার্সারি, গাভি, ছাগল ও কবুতরের খামার করে বেকারত্ব ঘুচিয়েছেন।
মাইদুল ইসলামের ২ একর জমিতে এখন বিভিন্ন জাতের গাছের চারা রয়েছে। ২০টি ছাগলের একটি খামারও করেছেন। মাইদুল বলেন, নার্সারি একটি লাভজনক ব্যবসা। এখন বাজারে চারা গাছের প্রচুর চাহিদা। প্রকারভেদে একেকটি চারার উৎপাদন খরচ পড়ে ৩০-৩৫ টাকা। বিক্রি হয় ৫৫-৬০ টাকায়।
ওই গ্রামের নজরুল ইসলাম স্নাতক পাস করার পর চাকরি খুঁজেছেন চার বছর। মাঝে কিছুদিন ছোট ব্যবসা করেও সুবিধা করতে পারেননি। একদিন হেমন্তের কাছে ছুটে গিয়ে পরামর্শ নেন। নিজের বসতভিটায় ২০১৬ সালে তৈরি করেন গাভি ও ছাগলের খামার। এখন তাঁর বছরে আয় প্রায় আড়াই লাখ টাকা।
নজরুলের স্ত্রী শামীমা আক্তার বলেন, ‘একসময় আমাদের অভাব ছিল। এখন ভালো আছি। এসবই পরিশ্রমের সুফল। আগের মতো গ্রামে এখন কেউ বেকার নেই। পুরো গ্রাম এখন নার্সারী ও গরু ছাগলের খামারে ভরপুর। এ কৃতিত্ব হেমন্ত দাদার।’
হেমন্তের অনুপ্রেরণায় নার্সারি ও বিদেশি কবুতরের খামার করেছেন ওই গ্রামের মকবুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘হেমন্ত দাদার খামার দেখে পাঁচ বছর আগে নার্সারি আর কবুতরের খামার করেছি। ইতিমধ্যে খামার লাভজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ১০টি কবুতর দিয়ে শুরু করা খামারে এখন ২০০টি কবুতর আছে। দুই একর জমিতে করা নার্সারিতে ৩০ প্রজাতির ফলজ ও বনজ গাছের চারা আছে। কবুতর আর নার্সারির চারা বিক্রি করে মাসে খরচ বাদে ৩৮ হাজার টাকা আয় হচ্ছে।’
গোবরা গ্রামে ঢুকতেই হামিদা খাতুনের বাড়ি। তাঁর স্বামী ৭ বছর আগে ঘরের জিনিস বেচে মুদিদোকান দিয়েছিলেন। সেটা টেকেনি। স্বামীর মৃত্যুর পর চোখে অন্ধকার দেখছিলেন হামিদা। বাধ্য হয়ে হেমন্তের নার্সারিতে কাজ নেন। সেই সঙ্গে হেমন্তের পরামর্শে ১০ শতক জমিতে করেন নার্সারি। এক বছর পর চারা বিক্রি করে কিনেন চারটি ছাগল। পরের বছর আরও ২০ শতক জমি বর্গা নিয়ে নার্সারি বাড়িয়ে দেন। এরপর থেকে সুদিনের দেখা পান তিনি। সাত বছরে নার্সারি ও ছাগল পালনের টাকায় হামিদা এখন ৩২ শতক জমির মালিক।
অন্নদানগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বলেন, চাকরির পেছনে না ছুটে খামার করে হেমন্ত যে সাফল্য এনেছেন, তা অবিশ্বাস্য। তাঁর পথ অনুসরণ করে গোবরা গ্রামের প্রতিটি বাড়ি এখন খামারে পরিণত হয়েছে। দেশে শিক্ষিত বেকার যুবকদের জন্য তাঁর এ কাজ অবশ্যই অনুকরণীয়।