সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদরের অনেক বাসাবাড়ি, দোকানপাট এখনো বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে। হাসপাতাল ও উপজেলা প্রশাসনের সামনের রাস্তায় কোমরপানি। অনেক স্কুল-কলেজ, সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়ের প্রাঙ্গণজুড়ে বন্যার পানি থইথই করছে। কিছু কিছু স্থানে সরলেও পুরোপুরি না কমায় জমে থাকা কালো পানি দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। আজ মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, ১৭ জুন ফেঞ্চুগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। উপজেলা সদরের পাশঘেঁষা কুশিয়ারা নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি নামছেও ধীরগতিতে। এ জন্য এলাকাবাসীর দুর্ভোগ ও ভোগান্তি দূর হয়নি। এ ছাড়া পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী না পাওয়ায় বানভাসি মানুষের কষ্ট বেড়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলা সদর বাজারের পশ্চিমবাজার, পুববাজার, থানা রোড পয়েন্ট ও হাসপাতাল রোড এলাকার প্রধান রাস্তা বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে। অনেক দোকানপাটেও পানি। হাসপাতাল রোডের বেশির ভাগ দোকানেই হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি। এই রোড মাড়িয়ে উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে যেতে হয়। মানুষজন পানি মাড়িয়ে অফিস-হাসপাতালে যাচ্ছেন। অনেককে ভ্যানগাড়িতে চড়েও যেতে দেখা যায়। উপজেলা সদরের একাধিক সরকারি কার্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কলেজ পানিতে তলিয়ে আছে।
উপজেলার কটালপুর, খিলপাড়া, ইলাশপুর, পশ্চিম ইলাশপুর, পশ্চিম মল্লিকপুর গ্রাম ঘুরে গ্রামের চারপাশে পানি দেখা গেল। অনেকের বাড়িঘরের ভেতরে ও উঠানে পানি। তলিয়ে আছে খেতের ফসল, পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। গ্রামগুলোর বেশির ভাগ রাস্তাই পানিতে নিমজ্জিত। কেউ কেউ নৌকা দিয়ে পারাপার হচ্ছেন। আবার কারও কারও বাড়ির সামনে অস্থায়ী বাঁশের সাঁকো তৈরি করা হয়েছে। কেউবা নৌকা ও সাঁকোর অভাবে পানি মাড়িয়েই চলাচল করছেন।
পশ্চিম ইলাশপুর গ্রামে ঢোকার মূল রাস্তায় এখনো হাঁটু থেকে কোমরপানি। রাস্তার প্রবেশমুখে চল্লিশোর্ধ্ব আতিক মিয়ার টংদোকান। আতিক মিয়া জানান, তাঁর দোকানে হাঁটুসমান পানি ছিল। অনেক পণ্য নষ্ট হয়েছে। এখন দোকান থেকে পানি নামলেও গ্রামের একমাত্র রাস্তাটি তলিয়ে আছে। প্রতিদিন পানি মাড়িয়ে চলতে অনেক দুর্ভোগে পড়তে হয়।
সরেজমিনে ফেঞ্চুগঞ্জ বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ, আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দারুল উলুম ইসলামবাজার মাদ্রাসা, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়, সাবরেজিস্ট্রারের কার্যালয়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলীর কার্যালয়, ফেঞ্চুগঞ্জ জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা কমান্ড কার্যালয় প্রাঙ্গণে গোড়ালি থেকে হাঁটুসমান পানি দেখা গেছে।
আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে জমে থাকা পানিতে ময়লা-আবর্জনা ভাসছে, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বিদ্যালয়ে ঠাঁই নেওয়া ফাতেমা আক্তার বলেন, বিদ্যালয়ে ঝাড়ু দেওয়াসহ আয়ার কাজ করে মাসে সামান্য টাকা পান। তাঁর স্বামী ভ্যানচালক। দুজনের টাকায় কোনোমতে সংসার চলে। বন্যার পানি এখন তাঁদের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে।
উপজেলা সদরের পশ্চিমবাজার এলাকার ব্যবসায়ী মো. সুনাম উদ্দিন বলেন, তাঁর দোকানেও পানি উঠেছিল। এখন নেমেছে। তবে দোকানের সামনের সড়কে পানি থাকায় ক্রেতা কম আসছেন। অন্য ব্যবসায়ীদের মতো তাঁর দোকানের কেনাবেচাও কমে গেছে।
পশ্চিম মল্লিকপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল্লাহ আল মামুন (৪৬) জানান, তিনি তিনটি পুকুরে রুই, কাতলা ও কার্পজাতীয় মাছ চাষ করেছিলেন। বন্যার পানিতে অনেক মাছ ভেসে গেছে।
ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও উপজেলা প্রশাসনের অবস্থান পাশাপাশি। এক সপ্তাহ ধরে সেখানে যাওয়ার রাস্তাটি পানিতে তলিয়ে আছে। হাসপাতাল প্রাঙ্গণেও পানি। এর মধ্যে জরুরি চিকিৎসার জন্য পানি মাড়িয়ে হাসপাতালে আসতে হচ্ছে রোগী ও তাঁদের স্বজনদের। হাসপাতালের আশপাশের ১০ থেকে ১৫টি ওষুধের দোকানের ভেতরেও হাঁটু থেকে কোমরপানি। এ অবস্থায় হাসপাতালে রোগীদের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কমেছে।
বেলা দুইটার দিকে ওই সড়কে গিয়ে দেখা গেছে, রাস্তায় পানি থাকায় কোনো কোনো স্বজন রোগীকে পাঁজাকোলা করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। কাউকে কাউকে ভ্যানগাড়িতে নিয়ে যেতে দেখা গেল। অফিসগামী মানুষ প্যান্ট গুটিয়ে কিংবা ভিজিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছেন। পানির নিচে রাস্তায় খানাখন্দ থাকায় অনেকে দুর্ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছেন বলেও ব্যবসায়ীরা জানান।
ভ্যানচালক সাচ্চু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, বন্যা পরিস্থিতি শুরুর পর হাসপাতালের সামনের সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় চলাচলে সমস্যা হচ্ছিল। সেখানে কোনো নৌকাও নেই। এ জন্য তিনি ভ্যানে জনপ্রতি ২০ টাকা ভাড়ায় হাসপাতাল ও উপজেলা পরিষদগামী মানুষকে পারাপার করছেন। প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ জন পারাপার করছেন। তাঁর মতো আরও কয়েকজন ভ্যানচালক একই কাজ করছেন।
ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. রাশেদুল হক বলেন, স্বাভাবিক সময়ে হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৩৫০ জন চিকিৎসা নেন। হাসপাতালে ভর্তি হন ৪০ থেকে ৪৫ জন। বন্যায় হাসপাতালের সামনের রাস্তা প্লাবিত হওয়ায় স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় গড়ে ১০ শতাংশ রোগী কম আসছেন। এখনো যেহেতু উপজেলায় পানি নামেনি, তাই পানিবাহিত রোগের প্রকোপও শুরু হয়নি। তিনি বলেন, বর্তমানে হাসপাতালে আসা ৫ শতাংশ রোগী পানিবাহিত নানা রোগের চিকিৎসা নিচ্ছেন। বন্যার্তদের সেবায় উপজেলায় ৯টি চিকিৎসক দল গঠন করা হয়েছে। তারা আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে বন্যার্তদের চিকিৎসার পাশাপাশি বিনা মূল্যে ওষুধ দিচ্ছে।
রত্না নদীর পাড় ঘেঁষেই কটালপুর উত্তরপাড়া গ্রাম। গ্রামের বাসিন্দা ও বিদ্যুৎ-কর্মী আবিদুল ইসলাম (২০) জানান, তাঁদের গ্রামের ২২০ থেকে ২৩০টি পরিবার এখনো পানিবন্দী। রান্নাঘর তলিয়ে যাওয়ায় মূল ঘরেই এখন তাঁদের রান্নাবান্নার কাজ সারছেন। বানভাসি হলেও তাঁর পরিবার ত্রাণসহায়তা পায়নি।
বেলা দেড়টার দিকে ফেঞ্চুগঞ্জ জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর সামনে দুই তরুণকে গাড়ি থামিয়ে টাকা তুলতে দেখা গেল। কাছে গেলে নিজেদের বেদে সম্প্রদায়ের সদস্য পরিচয় দেন। পাশেই নদীর পাড়ে অর্ধেক ডুবে থাকা কিছু ছাপড়া ঘর দেখিয়ে জানালেন, সরকারি জায়গায় তাঁরা ছাপড়া তৈরি করে অস্থায়ীভাবে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন। বন্যার পানিতে তাঁদের ১২টি পরিবারের সব ঘর তলিয়ে গেছে। জিনিসপত্র ভেসে গেছে।
কবির উদ্দিন (২০) ও হাজির হোসেন (২৮) নামের ওই দুই তরুণ বলেন, বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় তাঁরা এখন টাকা ও খাবারের সংকটে পড়েছেন। বন্যার শুরুতে স্থানীয় সংসদ সদস্য কিছু চাল দিয়েছিলেন। বন্যার পর কোনো ত্রাণ পাননি। পেটের ক্ষুধায় অনেকটা বাধ্য হয়েই মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলছেন। যে টাকা পাওয়া যাবে, সেই টাকায় তাঁরা সবাই মিলে চাল-ডাল কিনে খাবেন।
ডাকবাংলো পেরিয়ে কয়েক শ মিটার দূরে উপজেলা সদরমুখী রাস্তার বাঁ পাশে দুই নারীকে হাঁটুপানি মাড়িয়ে আসতে দেখা গেল। তাঁদেরই একজন বিউটি বেগম (২৬) বলেন, দিনমজুর স্বামী ও দুই ছেলেকে নিয়ে তাঁর সংসার। নিজের জমি বা ঘর নেই। কুশিয়ারা নদীর পাড়ে সরকারি জায়গায় ঘর বেঁধে আছেন। ঈদের দিন হঠাৎ ঘরে হু হু করে পানি ঢুকতে শুরু করে। অনেক জিনিসপত্র নদীর স্রোতে ভেসে গেছে। খাবারের সংকটে আছেন। অথচ এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণসহায়তা পাননি। একই অভিযোগ করলেন কোমরপানিতে তলিয়ে থাকা আরেক ঘরের বাসিন্দা কমলা বেগম (৪০)।
ত্রাণসংকটের বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা প্রিয়াংকা প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলায় ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছিল। কুশিয়ারা নদীর পানি ধীরে নামছে। তাই এখনো গ্রামগুলো প্লাবিত আছে। উপজেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ হয়েছে। ত্রাণের কোনো সংকট নেই। রান্না করা খাবার, চাল, শুকনা খাবারসহ সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিবও ব্যাপকভাবে ত্রাণ দিচ্ছেন।
ত্রাণসহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ করা ব্যক্তিদের বিষয়ে ইউএনওকে জানালে তিনি বলেন, ‘বেদে পরিবারগুলো শুরুতেই ত্রাণ পেয়েছে। এরপরও তাঁদের বিষয়টি দরকার হলে আবার বিবেচনা করা হবে। এ ছাড়া কটালপুর উত্তরপাড়াসহ যেসব স্থানে ত্রাণ পাননি বলে উল্লেখ করলেন, সেগুলো খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। সত্যতা পেলে অবশ্যই দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
প্রথম দফা কথা বলার পৌনে এক ঘণ্টা পর ইউএনও কল করে জানান, তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি গতকাল সোমবার কটালপুর উত্তরপাড়া গ্রামে ত্রাণ বিতরণ করেছেন বলে জানিয়েছেন।