সুপেয় পানির জন্য বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকেন উপকূলবাসী

বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে পুকুর থেকে কলসিতে পানি নিয়ে ফিরছেন নারীরা। সম্প্রতি খুলনার কয়রা উপজেলার পাথরখালী গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

খুলনার কয়রা উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দক্ষিণে পাথরখালী গ্রাম। নদীভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে বেড়িবাঁধের পাশে মানুষের বসতি। গ্রামের সব নলকূপের পানি লবণাক্ত। এলাকাবাসীকে প্রতিদিন দুই-তিন কিলোমিটার দূর থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হয়। তবে বর্ষাকাল ছাড়া বছরের বাকি সময় তাঁদের পুকুরের পানি পান করতে হয়।

ছয় সদস্যের পরিবারের জন্য প্রতিদিন এক কিলোমিটার দূরের একটি পুকুর থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করেন ওই গ্রামের সুমিত্রা দেবী। তিনি বলেন, বর্ষাকালের তিন-চার মাস ছাড়া বাকি সময় খাওয়ার পানির তীব্র সংকট থাকে তাঁদের। পুকুরের পানি খেতে হয়। এ বছর এখনো বৃষ্টির দেখা নেই। বৃষ্টির পানির জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, খুলনার ২২ ও সাতক্ষীরার ১৩ শতাংশ মানুষ খাওয়ার পানির সংকটে ভুগছেন। তবে বাস্তবের চিত্র ভিন্ন। ২০২১ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) জরিপের ফলাফল বলছে, খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা এবং সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলায় বসবাসকারী ৭৩ শতাংশ মানুষ অনিরাপদ লবণাক্ত পানি পান করছেন। প্রতি লিটারে এক হাজার মিলিগ্রামের বেশি লবণাক্ততা থাকলে তা পানযোগ্য নয় হিসেবে বিবেচিত হয়। অথচ ওই উপজেলাগুলোর পানিতে প্রতি লিটারে ১ হাজার ৪২৭ মিলিগ্রাম থেকে ২ হাজার ৪০৬ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণাক্ততা আছে। এসব এলাকার ৫২ শতাংশ পুকুর ও ৭৭ শতাংশ নলকূপের পানিতে বেশি মাত্রায় লবণাক্ততা পাওয়া গেছে।

প্রকল্পের সমন্বয়কারী আলমগীর হোসেন বলেন, উপকূলীয় পাঁচ উপজেলায় তিন দশক ধরে লবণাক্ততা বাড়ছে। কয়েকটি এলাকায় চিংড়ি চাষের কারণে সুপেয় পানির সংকট বেড়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় দুর্যোগে পুকুর লোনাপানিতে ভরে গেলেও সংস্কার করা হয়নি।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আকমল হোসেন বলেন, উপকূলের পানির সমস্যা সমাধানে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে পুকুর খনন ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে পানির ট্যাংক বিতরণ করা হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা জানা গেছে, কয়রা উপজেলার অধিকাংশ এলাকার খাওয়ার পানির প্রধান উৎস পুকুর। উপজেলার মহেশ্বরীপুর, বাগালী ও আমাদি ইউনিয়নে পানির সংকট তীব্র। সেখানকার কোনো নলকূপই কার্যকর নয়। একই অবস্থা মহারাজপুর ও কয়রা সদর ইউনিয়নের কিছু অংশেও। উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষ সুপেয় পানির সংকটে ভুগছেন।

পুকুর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করছে এক শিশু। সম্প্রতি খুলনার কয়রা উপজেলার ৫ নম্বর কয়রা গ্রামে

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন বলেন, পানির সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন সময় রেইন ওয়াটার হারভেস্ট (ট্যাংক), গভীর নলকূপসহ নানা ধরনের প্রকল্প নেওয়া হলেও টেকসই হয়নি। অনেক সময় পুকুর খনন করা হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগে লবণ পানিতে সেগুলো তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া অধিকাংশ পুকুরে ফিল্টার বা পিএসএফ অকেজো হয়ে আছে।

খুলনার দাকোপ, পাইকগাছা এবং সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগরের বিভিন্ন উপকূলীয় গ্রামে সরেজমিনে দেখা গেছে, সুপেয় পানির তীব্র সংকট। এলাকার চারদিকে চিংড়ির ঘের। এক কলসি খাওয়ার পানি সংগ্রহের জন্য নারী, শিশু, বৃদ্ধরা এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ছুটছেন।

উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র বলেন, ঘূর্ণিঝড় আইলার আগে উপকূলে খাওয়ার পানির এত সংকট ছিল না। কিন্তু আইলার সময় খাওয়ার পানির সব উৎস লবণাক্ত পানিতে ডুবে যায়। সেগুলোতে এখন চিংড়ির ঘের করা হয়েছে। এতে খাওয়ার পানির সংকট দিন দিন বাড়ছে।

কয়রা থেকে সাতক্ষীরার উপকূলীয় উপজেলা আশাশুনি ও শ্যামনগরকে আলাদা করেছে কপোতাক্ষ নদ। প্রতিদিন নৌকায় কপোতাক্ষ পাড়ি দিয়ে কয়রার মদিনাবাদ গ্রামের একটি নলকূপ থেকে পানি নিয়ে যান আশাশুনির চাকলা গ্রামের রউফ হোসেনসহ আরও অনেকে।

রউফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের এলাকার নলকূপের পানি লবণাক্ত ও আর্সেনিক। এক কলস খাওয়ার পানির জন্য প্রতিদিন নদী পার হয়ে কয়রায় আসতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। কারণ, কয়েক গ্রামের মানুষ ওই একটি নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করেন। বৃষ্টির সময় পানি ধরে রাখি।’

দাকোপ উপজেলার কালাবগী, সুতারখালী, কামারখোলা ও গুনারী ইউনিয়নে পানির সংকট তীব্র। এসব এলাকায় সাত-আট কিলোমিটার দূর থেকে খাওয়ার পানি আনতে হয়। অধিকাংশ পরিবার শুকনা মৌসুমে পুকুরের পানি পান করে। কালাবগী গ্রামের শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সুন্দরবনের ভেতরে একটি পুকুর থেকে প্রতি সপ্তাহে পানি নিয়ে আসি। নৌকায় করে বেশ কয়েকটি ড্রাম ও কলসিতে করে পানি আনি। ফিটকিরি দিয়ে সেই পানি পান করি।’

পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করছেন নারীরা। পাশেই পানি শোধনের ফিল্টারটি অকেজো পড়ে আছে। সম্প্রতি কয়রা গ্রামে

উপকূলীয় এলাকার মানুষের খাওয়ার পানির সমস্যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছে বেসরকারি সংস্থা জাগ্রত যুব সংঘ। সংস্থাটির সমন্বয়ক আবদুল মালেক বলেন, বছরজুড়েই লোনাপানির সঙ্গে লড়াই করেন উপকূলবাসী। গভীর বা অগভীর নলকূপ অকার্যকর হওয়ায় বৃষ্টি ও পুকুরের পানিই ভরসা। বর্ষা থেকে আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাঁরা বৃষ্টির পানি পান করেন। এরপর জমিয়ে রাখা বৃষ্টির পানি দিয়ে কয়েক দিন চলেন। তবে বেশির ভাগ পরিবারের পানি জমিয়ে রাখার বড় পাত্র বা ট্যাংক নেই। কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সংস্থা নামমাত্র মূল্যে ছোট-বড় প্লাস্টিকের ট্যাংক দিচ্ছে। তবে সবাই সেই সুবিধা পাচ্ছেন না।

২০১৬ সালে কয়রার বাঁশখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পন্ড অ্যান্ড স্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) বসায় একটি বেসরকারি সংস্থা। কিন্তু এক বছর না যেতেই পানি শোধনে ব্যবহৃত পাথর, বালু, দেয়াল ও টিউবওয়েল নষ্ট হতে থাকে। সংস্কারের অভাবে একপর্যায়ে সেটি কার্যকারিতা হারায়।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সরজিৎ রায় বলেন, সংস্থাগুলো প্রযুক্তি বসিয়ে দায়িত্ব শেষ করে। তদারকি থাকে না। তাঁরা যন্ত্রপাতি কিনে কয়েকবার মেরামত করেছেন। কেউ খরচ দিতে চান না। ধীরে ধীরে সেটি নষ্ট হয়ে যায়। এখন বিদ্যালয়ের পুকুরের পানি পান করছে মানুষ।

কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা সুজিত কুমার বৈদ্য বলেন, বাধ্য হয়ে মানুষ পুকুরের পানি পান করেন। শোধনহীন পানি খেয়ে প্রতিদিন ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটের পীড়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।