উপজেলা পরিষদ নির্বাচন

দলীয় নির্দেশ অমান্য করে পলাশে চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন আওয়ামী লীগের এমপির সম্বন্ধী

নরসিংদীর পলাশ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী মো. শরীফুল হক। তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আশরাফ খানের সম্বন্ধী (স্ত্রীর বড় ভাই)
ছবি: সংগৃহীত

নরসিংদীর পলাশ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আশরাফ খানের সম্বন্ধী (স্ত্রীর বড় ভাই) মো. শরীফুল হক। মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের আত্মীয়দের উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হবে বলে জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলের এ সিদ্ধান্ত মেনে না নিয়ে শরীফুল হক এখনো নির্বাচনের মাঠে রয়েছেন। আজ সোমবার প্রথম ধাপের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনেও তিনি তাঁর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেননি। উল্টো দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে পুরোদমে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

মো. শরীফুল হক পলাশের ঘোড়াশাল পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি। পলাশ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি ছাড়াও চেয়ারম্যান পদে আরও দুজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাঁরা হলেন বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি সৈয়দ জাবেদ হোসেন এবং উপজেলা জাতীয় পার্টির সদস্যসচিব কাজী নজরুল ইসলাম সারোয়ার মোল্লা। এ ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান পদে তিনজন এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে দুজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

এমপি তাঁরা, মেয়র তাঁরা, ইউপি চেয়ারম্যান তাঁরা, উপজেলা চেয়ারম্যানটা বাদ থাকবে কেন? এবার এইটা দখল করার চেষ্টায় আছেন তাঁরা। এখন এটাও পেয়ে গেলে ষোলোকলা পূর্ণ হয় তাঁদের। আমি দুই দফা দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীকে বিজয়ী হয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছি। তাই এত প্রতিকূলতার মধ্যেও আমি নির্বাচনের মাঠে আছি।
সৈয়দ জাবেদ হোসেন, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, পলাশ

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ারুল আশরাফ খান সমর্থন দিয়েছেন তাঁর সম্বন্ধী শরীফুল হককে। তবে আগের দুটি উপজেলা নির্বাচনে সংসদ সদস্যের সমর্থন নিয়ে চেয়ারম্যান হন উপজেলা যুবলীগের সভাপতি সৈয়দ জাবেদ হোসেন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাওয়ায় জাবেদের সঙ্গে আনোয়ারুলের দূরত্ব তৈরি হয়। এর আগে ঘোড়াশাল পৌর নির্বাচনে সংসদ সদস্য আনোয়ারুলের ভাগনে আল মুজাহিদ হোসেন ওরফে তুষার প্রার্থী হন, তখন দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে শরীফুল সরে দাঁড়ান। এবার শরীফুল হককে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করতে উঠেপড়ে নেমেছেন সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আশরাফ খান। এ বিষয়ে এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটি বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সৈয়দ জাবেদ হোসেন।

বর্তমান সংসদ সদস্যের সঙ্গে আমার ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে, কিন্তু আমাদেরও দীর্ঘদিনের আওয়ামী রাজনীতির ঐতিহ্য রয়েছে। সংসদ সদস্যের ভরসায় নয়, পলাশের জনগণের ভরসায় আমি এবার প্রার্থী হয়েছি। তাই নির্বাচনের মাঠেই থাকব।
মো. শরীফুল হক, উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী

এসব ব্যাপারে সৈয়দ জাবেদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলীয় সিদ্ধান্তের কোনো তোয়াক্কা না করে বর্তমান ও সাবেক সংসদ সদস্যের ছবি ব্যানারে ব্যবহার করে জায়গায় জায়গায় উঠান বৈঠক ও প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন মো. শরীফুল হক। তাঁর একাধিক উঠান বৈঠকে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আশরাফ খান, সাবেক সংসদ সদস্য কামরুল আশরাফ খান, ঘোড়াশাল পৌরসভার মেয়র আল মোজাহিদ হোসেন বক্তব্য দিয়েছেন। পাশাপাশি আমার পক্ষের নেতা-কর্মীদের হুমকি দিয়ে তাঁরা বলছেন, তাঁদের বাইরে কেউ নির্বাচন করতে পারবেন না। জোর করে হলেও তাঁরা বিজয়ী হবেন।’

এ বিষয়ে এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটি বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সৈয়দ জাবেদ হোসেন।

২০ এপ্রিল রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নির্দেশ দেন, মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের আত্মীয়দের উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগের এই সিদ্ধান্তে তৃণমূল পর্যন্ত মানুষ কিন্তু খুশি হয়েছে। তার কারণ হচ্ছে একটা দলে আমি এমপি, আমি মন্ত্রী, আবার আমার ভাই, ছেলে—এরাও পদ নিয়ে যাবে সব, তাহলে তৃণমূলের কর্মীরা কী করবে? তাদের পদে যাওয়ার কোনো অধিকার নেই? সে সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই এই সিদ্ধান্ত।’

এদিকে নরসিংদী-২ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আশরাফ খানের পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের দলীয় পদ দখলসহ মেয়র-চেয়ারম্যান হওয়ার নজির ভূরি ভূরি। তাঁর ছোট ভাই কামরুল আশরাফ খান এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। ভাগনে আল মুজাহিদ হোসেন ঘোড়াশাল পৌরসভার মেয়র। পলাশের চার ইউনিয়নের মধ্যে চরসিন্দুর ইউপির চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হোসেন তাঁর বেয়াই। ডাঙ্গা ইউপির চেয়ারম্যান সাবের উল হাই তাঁর ফুফাতো ভাই। গজারিয়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বদরুজ্জামান তাঁর ভাতিজা। জিনারদী ইউপির চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম গাজীর উকিল বাবা তিনি। এ ছাড়া মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফরোজা দিলীপ তাঁর স্ত্রী, পৌর মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ডোরা খান তাঁর ছোট বোন এবং পৌর যুবলীগের সভাপতি মনির হোসেন তাঁর শ্যালক।

এসব ব্যাপারে পলাশ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সৈয়দ জাবেদ হোসেন আরও বলেন, ‘এমপি তাঁরা, মেয়র তাঁরা, ইউপি চেয়ারম্যান তাঁরা, উপজেলা চেয়ারম্যানটা বাদ থাকবে কেন? এবার এইটা দখল করার চেষ্টায় আছেন তাঁরা। এখন এটাও পেয়ে গেলে ষোলোকলা পূর্ণ হয় তাঁদের। আমি দুই দফা দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীকে বিজয়ী হয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছি। পলাশের সাধারণ মানুষ আমাকে আবার উপজেলা চেয়ারম্যান পদে দেখতে চান। তাই এত প্রতিকূলতার মধ্যেও আমি নির্বাচনের মাঠে আছি।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. শরীফুল হক বলেন, ‘আমি ১০ বছর ঘোড়াশাল পৌরসভার মেয়র ছিলাম। এবারও স্থানীয় ভোটারদের মতামতের ভিত্তিতে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছি। ছাত্রজীবন থেকে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতে করতে নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এ পর্যন্ত এসেছি। বর্তমান সংসদ সদস্যের সঙ্গে আমার ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে, কিন্তু আমাদেরও দীর্ঘদিনের আওয়ামী রাজনীতির ঐতিহ্য রয়েছে। সংসদ সদস্যের ভরসায় নয়, পলাশের জনগণের ভরসায় আমি এবার প্রার্থী হয়েছি। তাই নির্বাচনের মাঠেই থাকব।’

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ারুল আশরাফ খানের ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার কল দেন এই প্রতিবেদক। তাঁর মুঠোফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। পরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম গাজীর মুঠোফোন নম্বরে কয়েক দফা কল দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। তাই তাঁরও বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

নরসিংদীর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আজ প্রথম ধাপের মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনে কোনো প্রার্থীই মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেননি। পলাশের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনজন প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন। ৮ মে ওই উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করতে আমরা সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’