ফুটপাতের প্রশস্ততা এমনিতেই কম। তার ওপর স্টেশনের পিলার, সিঁড়ির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে পুরো ফুটপাত। এটিকে প্রকল্পের ‘বড় ভুল’ বলছেন পরিবহনবিশেষজ্ঞরা।
রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত সাড়ে ২০ কিলোমিটার সড়কে সাত বছর ধরে চলছে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ। দফায় দফায় সময় ও ব্যয় বাড়ানো প্রকল্পটি চলতি বছরের আগস্ট মাসে খুলে দেওয়া হতে পারে।
তবে ফুটপাত বন্ধ করে স্টেশনের স্থাপনা নির্মাণ, বিশেষ লেনের দুই পাশে বিভাজক না রাখা এবং সড়কের পাশের পোশাক কারখানার শ্রমিকদের চলাচলের সুযোগ না থাকায় প্রকল্পের সামগ্রিক সুফল নিয়ে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। যানজট, ভোগান্তির পাশাপাশি দুর্ঘটনার ঝুঁকিও থেকে যাচ্ছে।
ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা পথে চলাচলকারীদের দুর্ভোগ লাঘবে নেওয়া এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে মাত্র ৪০ মিনিটে বাসে করে গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর যাতায়াত করা যাবে।
বিআরটির পূর্বশর্তই হলো যাত্রী বা পথচারীদের চলাচলে আবেদন সৃষ্টিকারী চওড়া ফুটপাত। এখানে উল্টো ফুটপাত বন্ধ করে স্টেশন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সমস্যা আরও বেড়ে গেল।অধ্যাপক সামছুল হক, পুরকৌশল বিভাগ, বুয়েট
জানতে চাইলে গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান হোসাইন মো. শাহিন প্রথম আলোকে বলেন, বিআরটি অংশ বাদ দিলে এই সড়কে একটি করে লেন। একটি লেন দিয়ে যানবাহন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারবে না।
প্রকল্পের সবচেয়ে বড় ভুল পোশাক কারখানার শ্রমিকদের কথা ভাবা হয়নি। তাঁরা কিন্তু বিআরটি বাসে উঠবেন না। তাঁদের হাঁটার জায়গাও বন্ধ হচ্ছে। এই প্রকল্প নিয়ে মন্তব্য করতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই, সাধারণ মানুষও বুঝতে পারবে এর ভবিষ্যৎ খারাপ।
তবে বিআরটি প্রকল্পের পরিচালক ইলিয়াস শাহ প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পটি নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু বলতে বা শঙ্কা প্রকাশ করতে পারেন। তবে প্রকল্প চালু হলে বলা যাবে, কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে। সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।
বিআরটির জন্য বিশেষ লেনের দুই পাশে নেই সড়ক বিভাজক। স্টেশনগুলো বিআরটি লেনের ওপর। উচ্চতা প্রায় ৬ মিটার। স্টেশনের দুই পাশের পিলার ফুটপাতের ওপর। স্টেশনে ওঠানামার জন্য চারটি চলন্ত ও পায়ে হাঁটার দুটি সিঁড়ি রাখা হয়েছে। সব কটি ফুটপাতের ওপর। এ জন্য স্টেশন এলাকায় ফুটপাত বন্ধ হয়ে গেছে। এসব জায়গা পার হতে পথচারীদের মূল সড়কে নামতে হচ্ছে।
প্রকল্পে কী আছে
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চার বছর মেয়াদ ছিল প্রকল্পটির। কিন্তু কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। পরে তিন দফা প্রকল্প সংশোধন করে এ বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৩৯৮ কোটি ৪ লাখ টাকা। তিন দফা সংশোধনের পর ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। শুরুতে প্রকল্পের দৈর্ঘ্য ছিল চান্দনা চৌরাস্তা থেকে ঢাকার কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত। পরে সময় ও ব্যয় বাড়ানো হলেও প্রকল্পটি সংকুচিত করে চান্দনা চৌরাস্তা থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত করা হয়। প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)।
প্রকল্পে এলিভেটেড (উড়াল অংশ) থাকছে ৮ দশমিক ৫ কিলোমিটার। স্টেশন ২৫টি। এর মধ্যে ঢাকায় ৪টি ও গাজীপুর মহানগরীতে পড়েছে ২১টি। উড়ালসড়ক থাকছে ৯টি, প্রতিটি স্টেশনেই থাকবে পদচারী–সেতুর ব্যবস্থা। প্রকল্পের ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নে সওজের কাজ ১৬ কিলোমিটার, যার মধ্যে ৯টি উড়ালসড়ক। উড়ালসড়কের কাজ শেষ হয়েছে। এলজিইডির আওতাধীন দুটি প্যাকেজের অগ্রগতি শতভাগ। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৯০ শতাংশ।
সরেজমিন চিত্র
৯টি উড়ালসড়কের কোনোটির একটি লেন আবার কোনোটির দুই দিকের লেন খুলে দেওয়া হয়েছে। ২৫টি স্টেশনের মধ্যে একটির কাজও শেষ হয়নি। সড়ক পারাপারে প্রতিটি স্টেশনে পদচারী–সেতু নির্মাণের কথা থাকলেও মাত্র একটির কাজ শেষ হয়েছে। বিআরটির জন্য বিশেষ লেনের দুই পাশে নেই সড়ক বিভাজক। স্টেশনগুলো বিআরটি লেনের ওপর। উচ্চতা প্রায় ৬ মিটার। স্টেশনের দুই পাশের পিলার ফুটপাতের ওপর। স্টেশনে ওঠানামার জন্য চারটি চলন্ত ও পায়ে হাঁটার দুটি সিঁড়ি রাখা হয়েছে। সব কটি ফুটপাতের ওপর। এ জন্য স্টেশন এলাকায় ফুটপাত বন্ধ হয়ে গেছে। এসব জায়গা পার হতে পথচারীদের মূল সড়কে নামতে হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআরটির মাঠপর্যায়ের একজন প্রকৌশলী বলেন, ‘ফুটপাতের প্রশস্ততা এমনিতেই কম। তা ছাড়া জায়গায় জায়গায় স্টেশনের পিলার ও সিঁড়ি বসায় এটি কোনো কাজে আসবে না। মানুষজনকে ঘুরেফিরে রাস্তায় হাঁটতে হবে। প্রকল্পের শুরুতে যেভাবে নকশা করা হয়েছে বা ঊর্ধ্বতন স্যাররা যেভাবে নির্দেশনা দিচ্ছেন, আমাদের সেভাবেই কাজ করতে হচ্ছে।’
সড়কে ক্রমেই যানবাহন বাড়ছে। বিআরটি স্টেশন এলাকাগুলোতে সড়ক কিছুটা চেপে যাওয়ায় যান চলাচলে ধীরগতি দেখা দিচ্ছে। এর মধ্যে মানুষ ফুটপাত ব্যবহার করতে না পারলে ব্যাপক যানজট দেখা দেবে।গাজীপুর মহানগর ট্রাফিক পুলিশের উপকমিশনার আলমগীর হোসেন
মালেকের বাড়ি এলাকার ব্যবসায়ী স্বপন হোসেন বলেন, গাজীপুরে অনেক কলকারখানা আছে। প্রতিদিন ফুটপাত দিয়ে হাজার হাজার শ্রমিক চলাচল করেন। সড়ক চালুর আগে ফুটপাত তৈরিতে জোর দিতে হবে। গাজীপুরের বলাকা পরিবহনের চালক হারুন অর রশিদ বলেন, বিআরটির বাস চলার জন্য মাঝে আলাদা লেন করা হয়েছে। সাধারণ যানবাহন চলাচলে দুই পাশে যে জায়গা রাখা হয়েছে, তা খুবই কম। অনেক জায়গায় ফুটপাতও নেই।
যানজটের আশঙ্কা
বিআরটি স্টেশনের স্থাপনার কারণে ওই এলাকার সড়ক কিছুটা সরু হয়ে গেছে। তিন লেনের রাস্তা কমে প্রায় দুই লেনে দাঁড়িয়েছে। এতে একসঙ্গে অনেক যানবাহন চলতে গিয়ে স্টেশন এলাকায় যান চলাচলে ধীরগতি দেখা দিচ্ছে। পাশাপাশি পথচারীরা সড়ক ধরে হাঁটায় মাঝেমধ্যে যানজট দেখা দিচ্ছে। মহানগর পুলিশ ও পরিবহন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সড়কটি শুধু উত্তরা, টঙ্গী ও গাজীপুরের মানুষই ব্যবহার করে না; বৃহত্তর ময়মনসিংহের সব জেলার মানুষের মূল পথ এটি। ঢাকার সঙ্গে কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, এমনকি বৃহত্তর সিলেটের সড়ক যোগাযোগেরও বিকল্প পথ এটি। উত্তরবঙ্গগামী যানবাহনের একটা বড় অংশ চলে উত্তরা-আবদুল্লাহপুর হয়ে। এ জন্য সড়কটি যানজটমুক্ত রাখা জরুরি।
গাজীপুর মহানগর ট্রাফিক পুলিশের উপকমিশনার আলমগীর হোসেন বলেন, সড়কে ক্রমেই যানবাহন বাড়ছে। বিআরটি স্টেশন এলাকাগুলোতে সড়ক কিছুটা চেপে যাওয়ায় যান চলাচলে ধীরগতি দেখা দিচ্ছে। এর মধ্যে মানুষ ফুটপাত ব্যবহার করতে না পারলে ব্যাপক যানজট দেখা দেবে।
ঝুঁকিতে পোশাকশ্রমিকেরা
সরেজমিনে দেখা যায়, ব্যস্ত সড়কে প্রচুর গাড়ি চলাচল করছে। এর মধ্যে দুপুরের খাওয়ার বিরতিতে সড়কে বের হয়েছেন বিভিন্ন পোশাক কারখানার হাজারো শ্রমিক। ফুটপাত না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা যানবাহনের মধ্যে সড়কের পাশ দিয়ে হাঁটছেন।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর গাজীপুর শাখা কার্যালয়ের তথ্যমতে, গাজীপুর মহানগরে নিবন্ধিত পোশাক কারখানা আছে ৪৯২টি। এর বাইরে ছোট–বড় কয়েক শ কারখানা আছে। এসব কারখানার অধিকাংশই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক-সংলগ্ন। প্রতিদিন সকালে কারখানায় যাওয়ার সময়, দুপুরে খাওয়ার বিরতি ও সন্ধ্যায় কারখানা ছুটির পর সড়কে হাজারো শ্রমিকের ঢল নামে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিকেরা সবাই পায়ে হাঁটা মানুষ। তাঁদের চলাচলে প্রশস্ত ফুটপাত খুবই জরুরি। কিন্তু এ সড়কে তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। বিআরটি প্রকল্পেও এর বাস্তবায়ন দেখা যায়নি।
প্রকল্প পরিচালক ইলিয়াস শাহ প্রথম আলোকে বলেন, স্টেশনের কারণে ফুটপাত বন্ধ হওয়ায় প্রকল্প ভুল পথে এগোচ্ছে, বিষয়টি এমন নয়। প্রকল্প শুরুর দিকে সড়কের পাশে পর্যাপ্ত জায়গা না পাওয়ায় এভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। পরে আরও জায়গা অধিগ্রহণ করে ফুটপাত বড় করা হবে।
তবে কর্তৃপক্ষের এমন আশ্বাসে ভরসা করতে পারছেন না সচেতন নাগরিক কমিটি গাজীপুর শাখার সদস্য অধ্যক্ষ মুকুল কুমার মল্লিক। তিনি বলেন, আগেও প্রকল্পের লোকজন অনেক আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনোটাই বাস্তবায়ন হতে দেখেননি। পরে জমি অধিগ্রহণ করে ফুটপাত প্রশস্তের বিষয়টি সন্দেহজনক । প্রকল্পটি ১২ বছর ধরে গাজীপুরবাসীকে ভোগাচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিআরটির পূর্বশর্তই হলো যাত্রী বা পথচারীদের চলাচলে আবেদন সৃষ্টিকারী চওড়া ফুটপাত। এখানে উল্টো ফুটপাত বন্ধ করে স্টেশন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সমস্যা আরও বেড়ে গেল। হাজার হাজার মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া হলো। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ এ দায় এড়াতে পারে না।