উপজেলার ১৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। এতে পাঠদান নিশ্চিত করা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন শিক্ষকেরা।
একতলা ভবনটির বিম ও স্তম্ভের (কলাম) বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। সেখানে মরিচা ধরা রডগুলো বের হয়ে এসেছে। ছাদ ও দেয়ালের পলেস্তারাও খসে পড়েছে। কয়েক মাস আগেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হলেও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের দুটি শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করে আসছিলেন শিক্ষকেরা। তবে গত সোমবার থেকে ওই ভবনে পাঠদান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এই চিত্র মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার নালী ইউনিয়নে বাঠইমুড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। শ্রেণিকক্ষের সংকট থাকায় শিক্ষার্থীদের পাঠদান নিয়ে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এখন হিমশিম অবস্থা। শুধু এই বিদ্যালয়েরই নয়, উপজেলার ১৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। এতে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে বিপাকে পড়েছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শিশুরাও কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও কমে গেছে।
বৃষ্টি হলে টিনশেডের ঘরটিতে পানি পড়ে। নতুন ভবনের জন্য একাধিকবার লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। তবে কোনো সুরাহা হয়নি।সাজ্জাদ হোসেন, সহকারী শিক্ষক, উভাজানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঘিওর
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি মানিকগঞ্জের প্রস্তাবিত কমিটির সভাপতি আবু সোহেল খান প্রথম আলোকে বলেন, ভবন বা শ্রেণিসংকটের কারণে কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা। অথচ প্রাথমিক বিদ্যালয়েই শিশুর শিক্ষার প্রাথমিক ভিত তৈরি হয়ে থাকে। কোনো কোনো বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষ–সংকটের কারণে গাদাগাদি করে শিশুদের ক্লাস করতে হচ্ছে। শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে বিদ্যালয়গুলোর নতুন ভবন নির্মাণ করা জরুরি।
সরেজমিনে উপজেলার সাইংজুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বানিয়াজুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাকজোড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাঠইমুড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং উভাজানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনগুলোর বেহাল অবস্থা দেখা গেছে।
গত সোমবার বাঠইমুড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জরাজীর্ণ ভবন এবং শিক্ষার পরিবেশ দেখতে যান উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এনামুল হক। এ সময় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একতলা ভবনে বিদ্যালয়ের তিনটি শ্রেণিকক্ষ ও একটি অফিসকক্ষ। ভিম ও স্তম্ভে বড় বড় ফাটলের কারণে যেকোনো সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে ভবনটিতে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
বাঠইমুড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) খালেদা মঞ্জুর এ খোদা বলেন, ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় প্রায় এক বছর ধরে প্রাক্-প্রাথমিক শ্রেণির শিশুদের ক্লাস নেওয়া বন্ধ রয়েছে। শ্রেণিকক্ষ সংকটের কারণে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছোট একটি ছাপরা ঘরের একটি মাত্র কক্ষে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। ভবনটি পরিত্যক্ত হওয়ায় গতকাল মঙ্গলবার শ্রেণিকক্ষগুলোতে তালা দিয়ে বারান্দায় শিশুদের ক্লাস নেওয়া হয়েছে। জরুরিভিত্তিতে বরাদ্দ পাওয়া গেলে সাময়িকভাবে তিনটি কক্ষবিশিষ্ট টিনের ছাপরা ঘর করা গেলেও শিশুদের ক্লাস নেওয়া যেত।
বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মোহিনী আক্তার বলে, ‘আমাদের স্কুলে আসলে ভয়ে থাকি কখন ভাইঙা পড়ে। নতুন করে স্কুল (ভবন) হইলে আনন্দ নিয়া ক্লাস করতে পারতাম।’
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ঘিওর উপজেলায় জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ১৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনের তালিকা করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এগুলো হলো সাইংজুরী প্রাথমিক বিদ্যালয়, বানিয়াজুরী প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাকজোড় প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাঠইমুড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়, উভাজানী প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর তরা প্রাথমিক বিদ্যালয়, বড়বিলা প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিংজুরী প্রাথমিক বিদ্যালয়, কুস্তা প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফুলহারা প্রাথমিক বিদ্যালয়, বড়টিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঘিওর আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়, আশাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়, শ্রীধরনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়, কালাচাঁদপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং বাংগালা প্রাথমিক বিদ্যালয়। এসব ভবন ২০ থেকে ৩২ বছরের মধ্যে করা হয়েছে।
উভাজানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গত বছর ২৭৬ শিক্ষার্থী ছিল। বিদ্যালয়ে দুটি ভবনে তিনটি শ্রেণিকক্ষ ও একটি অফিসকক্ষ রয়েছে। শ্রেণিকক্ষ-সংকটের কারণে পুরাতন টিনশেডের ঘরেই শিশুদের কোনোরকমে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। টিনশেড এই ঘরের দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে ফাটল ও টিনের চালায় মরিচা পড়ে ফুটো হয়ে গেছে। বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, বৃষ্টি হলে টিনশেডের ঘরটিতে পানি পড়ে। নতুন ভবন নির্মাণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। তবে কোনো সুরাহা হয়নি।
১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সাইংজুরী রামেশ্বরপট্টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একতলা ভবন নির্মাণ করা হয় ১৯৯৪ সালে। চার কক্ষের এই বিদ্যালয় ভবনের তিনটিতে পাঠদান ও একটি কক্ষে অফিসের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। ছাদ ও দেয়ালে ফাটলের সৃষ্টি হওয়ায় এটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। বছরখানেক আগে কোনোরকমে মেরামত করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই কার্যক্রম চলে আসছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ কে এম আজাদ বলেন, ২০১৩ সালে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ করা হলেও নতুন ভবন হয়নি। এতে শিশুদের ঝুঁকির মধ্যেই ক্লাস নিতে হচ্ছে। শিক্ষার্থী সংখ্যাও কমে আসছে।
শিক্ষকেরা বলছেন, বিদ্যালয় ভবনগুলোর নির্মাণকাল খুব বেশি সময় না হলেও নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার ও যথাযথ মানের কাজ না হওয়ায় বেহাল হয়ে পড়েছে। তাঁরা দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিত্যক্ত এসব ভবন অপসারণ করে সেখানে নতুন ভবন নির্মাণের গুরুত্বারোপ করেন।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সেলিনা আখতার প্রথম আলোকে বলেন, জেলায় পরিত্যক্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয় ভবনগুলোর তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার পর গুরুত্ব অনুসারে বিদ্যালয়গুলোতে ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।