ফুটপাতে বাবার চায়ের দোকান। বাড়িতে মায়ের কাগজের ঠোঙা বানানোর ব্যবসা। মন্দিরের জমিতে বসবাস। অভাব-অনটন সংসারের নিত্যসঙ্গী। চন্দ্র শেখর চৌহানকে তাই পড়াশোনার পাশাপাশি মা–বাবার কাজে সহায়তা করতে হয়েছে। এর মধ্যেই শিক্ষাজীবনের প্রতিটি ধাপে কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল করে তিনি এখন বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক।
চন্দ্র শেখরের বাড়ি গাইবান্ধা জেলা শহরের শনিমন্দির রোডে। সাধনা আর পরিশ্রম করলে যে সাফল্য অর্জন করা যায়, তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন প্রথম আলো ট্রাস্টের শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া এই অদম্য মেধাবী। তিনি শিক্ষকতা করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
চন্দ্র শেখরের বাবা মানিক চৌহানের (৫২) নিজস্ব কোনো সহায়-সম্পদ নেই। মন্দিরের চার শতক জায়গায় বসবাস। বাড়ির কাছেই শনিমন্দির রোড ঘেঁষে শনিমন্দির। মন্দিরের কয়েক গজ দূরেই একই রোডের ফুটপাতে তাঁর চায়ের দোকান। দোকানে চা, পরোটা, পেঁয়াজু, শিঙাড়া বিক্রি করেন। মা মিনা চৌহান (৪৭) ঘরে বসে কাগজ দিয়ে ঠোঙা বানান। সেই ঠোঙা দোকানে বিক্রি করেন।
ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত হয়ে শুধু মা–বাবার কষ্ট দূর করবে, সেটা আমরা চাই না। তারা দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করবে, সেটাই আমরা ছেলেদের কাছে চাই।মিনা চৌহান, চন্দ্র শেখরের মা
চন্দ্র শেখর চৌহান ২০০৫ সালে গাইবান্ধা ল’কলেজ কিন্ডারগার্টেন থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেন। এরপর গাইবান্ধা সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পান। ২০১২ সালে গাইবান্ধা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসিতেও জিপিএ-৫ অর্জন করেন। এরপর ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভেটেরিনারি সায়েন্স অনুষদের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি হন। ২০২১ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন। স্নাতকোত্তরে কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য তিনি ‘প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল’ও অর্জন করেছেন।
চন্দ্র শেখর ২০২২ সালের ৩১ জুলাই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এসএসসি পাসের পর থেকে অদম্য মেধাবী হিসেবে চন্দ্র শেখরকে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তির আওতায় নেওয়া হয়। এরপর দীর্ঘ সাত বছর তাঁকে বৃত্তি দেয় এ তহবিল।
চন্দ্র শেখর চৌহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পত্রিকাটি আমাকে সহায়তা ও অনুপ্রেরণা দিয়ে সাহস জুগিয়েছে। যে কারণে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে। যেহেতু প্রথম আলো ট্রাস্ট্র আমার পাশে ছিল, তাই আমি আজীবন প্রথম আলো ট্রাস্টের সঙ্গেই থাকতে চাই।’
জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে পরিশ্রমের বিকল্প কিছুই নেই উল্লেখ করে চন্দ্র শেখর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি পরিশ্রম না করলে এ জায়গায় আসতে পারতাম না। পরিশ্রমের কারণে রেজাল্ট ভালো হয়েছে, পরবর্তী সময় শিক্ষকতা পেলাম। পারিবারিক অসচ্ছলতা কোনো বড় বাধাই নয়। মানুষের ইচ্ছা থাকলে যে কেউ ভালো করবেই।’
নিজের সফলতার পেছনে শিক্ষকদের অবদানও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন চন্দ্র শেখর। তিনি বিশেষভাবে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. জাকির হোসেন এবং তাঁর স্নাতকোত্তর পর্যায়ের সুপারভাইজর অধ্যাপক মো. তৌহিদুল ইসলামের কথা বিশেষভাবে স্মরণ করেন। নিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দেশের মানুষের কথাও চিন্তা করেন চন্দ্র শেখর। তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে একজনকে পড়াশোনার জন্য সহায়তা করছি। ভবিষ্যতে আরও চেষ্টা থাকবে।’
চন্দ্র শেখরের মা মিনা চৌহানও চান ছেলে দেশের কল্যাণে কাজ করুক। তিনি বলেন, ‘আমরা জীবনে যেভাবে কষ্ট করছি, ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত হয়ে শুধু মা–বাবার কষ্ট দূর করবে, সেটা আমরা চাই না। তারা দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করবে, সেটাই আমরা ছেলেদের কাছে চাই।’
মিনা চৌহানের ছোট ছেলে সৌরভ চৌহানও হাঁটছেন বড় ভাইয়ের পথেই। তিনি গাইবান্ধা সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০১৬ সালে এসএসসি এবং ঢাকা নটর ডেম কলেজ থেকে ২০১৮ সালে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। তাঁকেও ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি দিচ্ছে। সৌরভ চৌহান বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন।
মানিক চৌহান বলেন, ‘আমার দুই ছেলের পাশে যাঁরা ছিলেন, তাদের আমার ছেলেরা যেন মনে রাখে, বাবা হয়ে সেটাই আমার চাওয়া। এ ছাড়া ছাত্রজীবনে তারা যেভাবে সহায়তা পেয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হবার পর অন্য শিক্ষার্থীদের জন্য যেন ছেলেরা সেভাবেই সহায়তা করে।’