দেয়ালে ফাটল, আতঙ্কে রোগী

দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় ১০০ শয্যার এই হাসপাতালের ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি হলে ওয়ার্ডে পানি পড়ে। অস্ত্রোপচারও বন্ধ।

খুলনার ১০০ শয্যার বক্ষব্যাধি হাসপাতালের ভবনের ছাদের পলেস্তারা খসে পড়েছে

হাসপাতাল ভবনের দেয়ালে ফাটল ধরেছে। বৃষ্টি হলে ওয়ার্ডের মধ্যে পানি পড়ে। ভবনের দেয়াল ও ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ে লোহার রড বের হয়ে আছে। শৌচাগারগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী। এই জরাজীর্ণ অবস্থা খুলনার ১০০ শয্যার বক্ষব্যাধি হাসপাতালের। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় এই ভবনেই ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। এই ভবনে চিকিৎসা নিতে এসে রোগীরাও থাকেন আতঙ্কে। এই সমস্যার পাশাপাশি এখানে চিকিৎসক–সংকটে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় দুই বছর ধরে অস্ত্রোপচার বন্ধ রয়েছে।

খুলনা নগরের অন্য সরকারি হাসপাতালগুলোতে যখন রোগীদের উপচে পড়া ভিড়, তখন বক্ষব্যাধি হাসপাতালে রোগী শয্যার তুলনায় অনেক কম। ১০০ শয্যার এই হাসপাতালে প্রতিদিন মাত্র ৩০ থেকে ৩২ জন রোগী ভর্তি থাকে। হাসপাতালের ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা কেউ ভর্তি হতে চান না। করোনার পর থেকে এই রোগীসংকট বেড়েছে।

ওই হাসপাতালে রোগী ভর্তির গত মে মাসের তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, ওই মাসে ৩১ জন পুরুষ এবং ২০ জন নারী ভর্তি হয়েছেন। এই ৫১ জনের মধ্যে ২৯ জন ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা (এমডিআর টিবি) নিয়ে ভর্তি হন। ওই মাসে প্রতিদিন গড়ে ৩২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি থেকেছেন। আগের মাসগুলোতেও সংখ্যাটা প্রায় একই রকম।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৫ সালে খুলনা নগরের খানজাহান আলী থানা এলাকার মীরেরডাঙ্গায় সাত একর জায়গার ওপর খুলনা বক্ষব্যাধি হাসপাতাল নির্মিত হয়। পদ্মার এপারে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার যক্ষ্মা রোগ, বিশেষ করে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসায় ভরসাস্থল এই হাসপাতাল।

 হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এই হাসপাতালে চিকিৎসকের ১১টি পদের মধ্যে বিশেষজ্ঞের দুটিসহ পাঁচটিই শূন্য। এখন এখানে হাসপাপাতালের তত্ত্বাবধায়ক, চারজন চিকিৎসা কর্মকর্তা এবং একজন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা কর্মরত আছেন। পদ থাকলেও হাসপাতালে প্যাথলজি ও রেডিওলজির কোনো চিকিৎসকও নেই। নার্স ছাড়া অন্য সব পদে রয়েছে জনবলসংকট। হাসপাতালে ২৫ জন অফিস সহায়কের ১৬টি পদ ও ১৫টি পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পদের মধ্যে ১২টি শূন্য। আউটসোর্সিংয়ের লোক দিয়ে পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তার কাজ চালানো হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাসপাতালে সব ওয়ার্ড যক্ষ্মা রোগীর। আলাদা করে বক্ষব্যাধির চিকিৎসা দেওয়া হয় না। হাসপাতালে সেই অর্থে বহির্বিভাগ নেই। ভর্তিযোগ্য নয়, এমন রোগীদের দেখে কিছু পরীক্ষা করার প্রয়োজন হলে পরীক্ষা করিয়ে ব্যবস্থাপত্র লিখে দেওয়া হয়। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে বহির্বিভাগে রোগী দেখা হয়, তবে সব সময় ওষুধ দেওয়া হয় না। হাসপাতালে অস্ত্রোপচারকক্ষ আছে। তবে বুকে পানি জমার মতো পরিস্থিতিতে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন পড়লেও কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় তা সম্ভব হয় না। হাসপাতালে দুটি এক্স–রে যন্ত্র থাকলেও সেগুলো দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। ফলে রোগীদের দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত টাকা খরচ করে বাইরে গিয়ে এক্স–রে করাতে হচ্ছে।

হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ভবনের ছাদ ভেঙে পড়ছে, দেয়াল ভেঙে পড়ছে। বৃষ্টি পড়লে রোগীর গায়ে পানি পড়ে। সুরক্ষার জন্য ভান্ডারকক্ষ নিয়মিত কেরোসিন দেওয়া লাগে।

খুলনার শিরোমনি এলাকার মো. ইসমাইল (৮৫) দুই মাস ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হাসপাতালের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যাঁদের দীর্ঘ মেয়াদে চিকিৎসার দরকার হয়, মূলত তাঁরা এখানে ভর্তি হন। আমাদের এই ওয়ার্ডের দশটা শয্যায় আমরা মাত্র দুজন আছি। ফাঁকাই থাকে। দোতলার ওয়ার্ডে বৃষ্টি হলে পানি পড়ে। আমাদের নিচতলায় ছাদ ও দেয়াল থেকে প্লাস্টার খসে পড়ছে, তবে পানি পড়ে না। হাসপাতালের বাথরুম ব্যবহার করার উপযোগী নয়।’

অরক্ষিত হাসপাতাল

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, ভৈরব নদের তীরে গাছগাছালিতে ভরা মনোরম পরিবেশে হাসপাতালটি অবস্থিত। তবে হাসপাতালের জরাজীর্ণ দ্বিতল ভবনের সব ওয়ার্ড ও কক্ষের ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ছে। ভবনের ছাদ স্যাঁতসেঁতে। রোগীদের শৌচাগারগুলো একবারেই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারীদের জন্য পাঁচটি আবাসিক ভবন থাকলেও সেগুলোও ব্যবহারের অনুপযোগী। সব মিলিয়ে তিনটা পরিবার সেখানে বাস করে।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক প্রদীপ চন্দ্র মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলত জটিল যক্ষ্মারোগীরা এই হাসপাতালে ভর্তি থাকেন। এ হাসপাতালের সবচেয়ে বড় সমস্যা জরাজীর্ণ ভবন। গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশলীদের হাসপাতালে এনে দেখানো হয়েছে। জরাজীর্ণ ভবন এবং পরিত্যক্ত আবাসিক ভবনগুলো ভেঙে নতুন করে করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।’