‘ঘরের মধ্যে সাঁতারপানি। সবকিছু ভাসি নিয়ে গেছে। ঘরটাও আছে, নাকি ভাইসা গেছে, সেই খবরও লইতে পারলাম না। ঠিকমতো চলতে-ফিরতে পারি না। বানে সব শেষ। চার দিন হইলো গরু-বাছুর লইয়া ইস্টিশনে পইড়া আছি। ঘুম নাই। খাউন নাই। দিন-রাত সমান। বড় কষ্টের মধ্যে আছি।’ বন্যায় বাড়িঘর ছেড়ে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে আশ্রয় নেওয়া সত্তরোর্ধ্ব মালিকান বেগম আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন। যমুনার কোলঘেঁষা উপজেলার চকরিয়া গ্রামের বাসিন্দা তিনি।
দেওয়ানগঞ্জ উপজেলাটি যমুনা নদীর তীরবর্তী প্রতিবছর বর্ষায় এই উপজেলার বেশির ভাগ এলাকা বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ কয়েকবার করে নদীভাঙনের শিকার হয়েছেন। বেশির ভাগ মানুষ হতদরিদ্র। গত ছয় দিন ধরে বন্যা দেখা দেওয়ায় মালিকান বেগমের মতো উপজেলার প্রায় ৫০ হাজার পানিবন্দী মানুষ বিপাকে পড়েছেন।
মালিকান বেগম তাঁর ভাই তারা মিয়ার (৭৫) সঙ্গে রেলওয়ে স্টেশনে চার দিন ধরে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা মিয়া বলেন, সবার প্রথম তাঁদের গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশ করে। দুই দিন ঘরেই ছিলেন তাঁরা। গত বুধবার থেকে পানি চাপ বাড়তে থাকায় স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে গবাদিপশু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। গ্রামের প্রায় সবাই স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছেন। দিনে এক থেকে দুইবারের বেশি তাঁরা খেতে পারছেন না। আজ শনিবার রেলওয়ের কলোনি এলাকায় শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছিল। কিন্তু সবার কপালে সেটাও জোটেনি। চারদিকে পানিতে সবকিছু তলিয়ে যাওয়ায় কোনো কাজকর্ম নেই। সামনের দিনগুলোয় কীভাবে চলবেন, কী খাবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তাঁরা।
জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পানি পরিমাপক আবদুল মান্নান বলেন, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে জামালপুরে যমুনা নদীর পানি হু হু করে বেড়ে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আজ সারা দিন বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে আজ বিকেল ৪টায় যমুনার পানি বিপৎসীমার ৯২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
আজ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, দেওয়ানগঞ্জ পৌর শহরের বেলতলী এলাকায় প্রধান সড়কে হাঁটুপানি। ভারী যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বেলতলী বাজারের বেশির ভাগ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করেছে। বেলতলী এলাকায় উপজেলা সহকারী ভূমি কমিশনারের (এসি ল্যান্ড) কার্যালয়ে কোমরসমান পানি। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও পানি প্রবেশ করেছে। উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে হাঁটুপানি। দেওয়ানগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন প্রাঙ্গণেও পানি প্রবেশ করেছে। স্টেশনের চারপাশে পানি। শুধু ১ ও ২ নম্বর লাইনটি তলিয়ে যায়নি। ফলে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। পৌর শহর থেকে কয়েক মিনিটের পথ বালুগ্রাম। এই গ্রামের পাকা সড়কের ওপর দিয়ে নৌকা চলাচল করছে। দুর্গত এলাকার বেশির ভাগ অভ্যন্তরীণ সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সবার একমাত্র বাহন এখন নৌকা। বালুগ্রাম, মাঝিপাড়া, গুজিমারি, চকলাইপাড়া, দক্ষিণ বালুগ্রাম ও চরভসুর গ্রামের কোথাও কোমর, আবার কোথাও বুকসমান পানি।
বালুগ্রাম এলাকার বাসিন্দা ফুল বেগম (৪৮)। সাত মাস আগে তাঁর স্বামী মারা গেছেন। একমাত্র ছেলেও শারীরিক প্রতিবন্ধী। তাঁর ঘরের মধ্যে পাঁচ দিন ধরে পানি। ছেলেকে নিয়ে কোথাও আশ্রয়ও নিতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘বানে একদম শেষ। মানুষের বাড়িতে কাজকাম করেই চলি। পানির কারণে ঘর থেকেই বের হতে পারছি না। কাজকামে যাব কীভাবে। এদিকে ঘরে খাউন নাই। পুলাটা নিয়ে কষ্টের মধ্যে আছি। ভরা বানের মধ্যে কেউ কিচ্ছুই দিল না।’
ফুল বেগমের সঙ্গে কথা বলা অবস্থায় গ্রামের অনেকেই পানি মাড়িয়ে ছুটে আসেন। তাঁরা মনে করেছিলেন, ত্রাণ সহযোগিতা দিতে হয়তো সরকারি লোক এসেছেন।
দেওয়ানগঞ্জের চুকাইবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মো. মুক্তাদির। তাঁর ওয়ার্ডের মধ্যে বালুগ্রামটি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত মঙ্গলবার থেকে ইউনিয়নের বেশির ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। আমার ওয়ার্ডের ৫০০ পরিবার পানিবন্দী হয়েছে পড়েছে। বেশির ভাগ পরিবার হতদরিদ্র। কৃষিকাজ করে সংসার চালায়। সবকিছু তলিয়ে থাকায় তাঁরা এখন বেকার হয়ে পড়েছেন। অথচ পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী পাওয়া যায়নি।’
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মতে, জেলায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় আছেন। তবে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, বন্যায় জামালপুরের ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় ১ লাখ ৩ হাজার ৬৮০ জন মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া সরিষাবাড়ী ও বকশীগঞ্জ উপজেলায় ১০ হাজার ১০ জন মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। দুর্গত এলাকায় স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ হচ্ছে। ২৯৫ মেট্রিক টন চাল ও ২ হাজার ৬২৫ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ পর্যাপ্ত রয়েছে।