সিলেটে ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে এখনো পানিবন্দী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সব কটি গ্রাম। ডুবে থাকা ঘরের পাশ দিয়ে নিরাপদ স্থানের দিকে নৌকায় যাচ্ছে মানুষ। গত শুক্রবার উপজেলার তেলিখাল এলাকায়
সিলেটে ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে এখনো পানিবন্দী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সব কটি গ্রাম। ডুবে থাকা ঘরের পাশ দিয়ে নিরাপদ স্থানের দিকে নৌকায় যাচ্ছে মানুষ। গত শুক্রবার উপজেলার তেলিখাল এলাকায়

দুর্যোগে বেশি বাস্তুচ্যুত হয় সিলেটের মানুষ

চার বছর আগে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার মানাউরা গ্রামে নতুন ঘর তুলেছিলেন রহিম উদ্দিন। তবে গত তিন বছরে দুবার বন্যায় তাঁর ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বাড়ি ছেড়ে যেতে হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রে। এ বছরও বন্যার সময় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দুই দফা আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হয়েছে তাঁকে।

কখনো কৃষিকাজ করে, কখনো মাছ ধরে সংসার চালান রহিম উদ্দিন। নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বন্যা হলে প্রতিবারই আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হয়। কয়েক দিন আগের সর্বশেষ বন্যার সময় সাত দিন আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলাম।’

রহিম উদ্দিনের মতো অনেক মানুষই প্রতিবছর বন্যার সময় সাময়িক বাস্তুচ্যুত হয় বা নিজ বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। সাময়িক বাস্তুচ্যুতির এই হার সিলেট বিভাগের জেলাগুলোতে সবচেয়ে বেশি বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। সরকারি এই সংস্থার হিসেবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাময়িক বাস্তুচ্যুতিতে এর পরেই রয়েছে বরিশাল, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগের মানুষ।

বন্যা হলে প্রতিবারই আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হয়। কয়েক দিন আগের সর্বশেষ বন্যার সময় সাত দিন আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলাম।
রহিম উদ্দিন

বিবিএস প্রকাশিত সর্বশেষ আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ ২০২৩ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মানুষের সাময়িক বাস্তুচ্যুতির চিত্র দেওয়া হয়েছে।

বিবিএস বলেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক সময়েই মানুষ তার স্থায়ী বাসস্থান ছেড়ে সাময়িক সময়ের জন্য অন্য কোথাও আশ্রয় নেয় বা বসবাস করে। সাময়িক আশ্রয়ের ক্ষেত্রে বিবিএস তাঁবু টাঙিয়ে থাকা, অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া কিংবা বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্প বা শিবিরে অংশগ্রহণকে বুঝিয়েছে। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল—এই পাঁচ বছরে এ ধরনের সাময়িক বাস্তুচ্যুতির হিসাব করেছে সংস্থাটি।

জরিপে দেখা গেছে, দুর্যোগের কারণে দেশের সব কটি বিভাগের মধ্যে সিলেটে বাস্তুচ্যুতির হার বেশি। গত পাঁচ বছরে এই বিভাগের ১৫ দশমিক ১৪ শতাংশ মানুষ সাময়িক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বরিশাল বিভাগে বাস্তুচ্যুত হওয়ার হার ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ; আর রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগের যথাক্রমে ১ দশমিক ৫৯ এবং ১ দশমিক ১৩ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন দুর্যোগে নিজ বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিল।

বন্যার পরে অন্য কারণের তালিকার শীর্ষে ছিল নদীভাঙন ও ঘূর্ণিঝড়। এর মধ্যে গত পাঁচ বছরে নদীভাঙনে ১১ দশমিক ৮৪ শতাংশ ও সাইক্লোনে ৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। দেখা গেছে, নদীভাঙনের কারণে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় স্থানান্তরের হার বেশি।

বেশি বাস্তুচ্যুতি বন্যায়

বিবিএসের জরিপে উঠে এসেছে, সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বন্যার কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষ সাময়িক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। গত পাঁচ বছরে মোট বাস্তুচ্যুত মানুষের প্রায় ৬৩ শতাংশ স্থানান্তর হয়েছে এ কারণে। গ্রাম ও শহর—উভয় স্থানেই এমন বাস্তুচ্যুতির হার ৫০ শতাংশের ওপরে। বন্যার কারণে একই জেলার মধ্যে যেমন মানুষ স্থানান্তর হয়েছে, তেমনই অন্য জেলাতেও অনেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।

বন্যার পরে অন্য কারণের তালিকার শীর্ষে ছিল নদীভাঙন ও ঘূর্ণিঝড়। এর মধ্যে গত পাঁচ বছরে নদীভাঙনে ১১ দশমিক ৮৪ শতাংশ ও সাইক্লোনে ৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। দেখা গেছে, নদীভাঙনের কারণে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় স্থানান্তরের হার বেশি।

সাময়িক বাস্তুচ্যুতির পেছনে দায়ী অন্য দুর্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে জলাবদ্ধতা, স্রোতে ভেসে যাওয়া, ভূমিধস, খরা, শিলাবৃষ্টি ও লবণাক্ততা। এর মধ্যে একাধিক দুর্যোগের কারণে ১৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ মানুষের সাময়িক স্থানচ্যুতি হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেটে নদ-নদী ও হাওরে এমন সব উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে যেগুলো পরিবেশসম্মত নয়। সেখানকার প্রাকৃতিক জলাধার বেদখল হয়েছে, অপরিকল্পিতভাবে স্লুইসগেট, বাঁধ ও সড়ক নির্মাণ হচ্ছে; আর সুরমা নদীকে বানানো হয়েছে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়।

সিলেটে বাস্তুচ্যুতি বেশি কেন

টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢল নামায় সিলেট অঞ্চলের প্রধান দুটি নদী সুরমা ও কুশিয়ারাসহ সীমান্তবর্তী নদ-নদীর পানি বেড়ে যায়, যা পরে বন্যায় রূপ নেয়। বিভাগের জেলাগুলোতে বন্যা অনেকটা নিয়মিত ঘটনা। প্রতিবছর বন্যায় জীবন ও সম্পদের বিপুল ক্ষতি হয়। এ সময় লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।

সিলেটে চলতি বছর দুই দফায় বন্যা হয়েছে। কিছু এলাকা এখনো প্লাবিত হয়ে আছে। এর আগে ২০২২ সালে বিভাগটির ৮০ শতাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়; আর পানিবন্দী ছিল ৪০ লক্ষাধিক মানুষ।

সাধারণত উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, পদ্মাতীরবর্তী শরীয়তপুর, মাদারীপুর এবং উপকূলীয় জেলা ভোলায় নদীভাঙনের কারণে সবচেয়ে বেশি বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটত। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিলেটে হঠাৎ বন্যায় বিপুলসংখ্যক মানুষ অস্থায়ীভাবে বাস্তচ্যুত হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন মো. জিল্লুর রহমান

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেটে নদ-নদী ও হাওরে এমন সব উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে যেগুলো পরিবেশসম্মত নয়। সেখানকার প্রাকৃতিক জলাধার বেদখল হয়েছে, অপরিকল্পিতভাবে স্লুইসগেট, বাঁধ ও সড়ক নির্মাণ হচ্ছে; আর সুরমা নদীকে বানানো হয়েছে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। এতে সিলেট অঞ্চলের নদী ও হাওরের নাব্যতা কমেছে এবং পানির স্বাভাবিক প্রবাহ রুদ্ধ হয়েছে। মূলত এসব কারণে বারবার বন্যায় ডুবছে সিলেট, আর সাময়িক বাস্তুচ্যুত হচ্ছে বিপুলসংখ্যক মানুষ।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন মো. জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে বন্যা ও নদীভাঙনের কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। সাধারণত উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, পদ্মাতীরবর্তী শরীয়তপুর, মাদারীপুর এবং উপকূলীয় জেলা ভোলায় নদীভাঙনের কারণে সবচেয়ে বেশি বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটত। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিলেটে হঠাৎ বন্যায় বিপুলসংখ্যক মানুষ অস্থায়ীভাবে বাস্তচ্যুত হচ্ছে।

মো. জিল্লুর রহমান আরও বলেন, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সিলেট অঞ্চলের মানুষ কিছুটা সচ্ছল। ফলে সেখানকার বাস্তুচ্যুত মানুষেরা দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াতে পারছে। উত্তরাঞ্চলের মানুষের জন্য যা কঠিন। ফলে শুধু কত মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, সেই হার দিয়ে পুরো চিত্র বোঝা যাবে না। এ বিষয়ে কোনো নীতিনির্ধারণের আগে কত দিনের জন্য মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, তাদের আর্থিক অবস্থা কেমন এবং কত দিনের মধ্যে তারা আগের অবস্থায় ফিরতে পারে, এসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে।