প্রায় এক মাস আগেই প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল উৎসবের। অপেক্ষা ছিল ভরা পূর্ণিমার। এরপর এল কাঙ্ক্ষিত সেই দিন। মণিপুরি গ্রামের মণ্ডপের মাঝখানে বৃত্তাকারে ভূমিসমতল কুঞ্জ বা মণ্ডলী স্থাপন করা হয়েছে। মাটিতে আঁকা হয়েছে নানা আলপনা। সাজানো হয়েছে কুঞ্জের চারপাশ। মা-বাবার হাত ধরে সেজেগুজে একে একে মণ্ডপের দিকে আসতে থাকল মণিপুরি ছোট শিশুরা। তার পর থেকেই শুরু হলো মণিপুরিদের সবচেয়ে বড় উৎসব মহারাসলীলার।
গতকাল শুক্রবার সকালে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মাধবপুর জোড়া মণ্ডপে গিয়ে এমনটাই দেখা গেল। দিনের বেলা মহারাসলীলার প্রথম পর্ব দুপুরের আগেই শেষ হলো। সন্ধ্যা নামতেই শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব। অনুষ্ঠানমঞ্চে আয়োজিত আলোচনা সভায় একে একে বক্তব্য দেন অতিথিরা। এরপর মাঝরাতে শুরু হয় মহারাস উৎসবের মূল আয়োজন। রাতভর শ্রীকৃষ্ণর মহারাসলীলা পরিবেশনের মাধ্যমে দর্শকদের বিমোহিত করে রাখেন শিল্পীরা। চাঁদ ডুবে গিয়ে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে শেষ হয় রাস উৎসবের।
এবারও কমলগঞ্জের পৃথক দুটি স্থান মাধবপুর জোড়া মণ্ডপ ও আদমপুর গ্রামে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ও মেইতেই মণিপুরিদের আলাদা উৎসব হয়েছে। উৎসব উপলক্ষে মাধবপুর ও আদমপুরে বসেছিল রকমারি আয়োজনে বিশাল মেলা। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে দেশি-বিদেশি হাজারো মানুষ সমবেত হন এ উৎসবে।
রাসের প্রথম পর্বে, অর্থাৎ দিনের বেলায় শ্রীকৃষ্ণর শিশুকাল ও বাল্যকালের বিভিন্ন ঘটনা গান ও নাচের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেন মণিপুরি শিল্পীরা। শিল্পীদের মধ্যে বেশির ভাগই ছোট শিশু। রাসের দ্বিতীয় পর্ব, অর্থাৎ রাতের বেলা মহারাসের মূল পর্ব। এখানে কৃষ্ণর নানান ভাবের রূপায়ণ ঘটে। শ্রীকৃষ্ণর সঙ্গে আসেন রাধা রানী। রাধা-কৃষ্ণর নানান লীলা গীতনৃত্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়।
মণিপুরি থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা ও নাট্যকার শুভাশিস সিনহা প্রথম আলোকে বলেন, রাসলীলার গানগুলো বিখ্যাত বৈষ্ণব পদকর্তা জয়দেব, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস প্রমুখের পদাবলি থেকে সংগৃহীত। বাংলা, ব্রজবুলি, মৈথিলী ও সংস্কৃত ভাষার পদ সংকলিত হলেও সাম্প্রতিক কালে মণিপুরি ভাষাতেও রাসলীলার পদ বা গান রচিত হচ্ছে। রাসলীলার আয়োজনে অনেক আধুনিকায়ন ঘটেছে। আগে হ্যাজাকের আলোয় হতো, তারও আগে মশাল জ্বালিয়ে। এখন হয় ঝলমলে বিদ্যুতের আলোয়।
রাসের ইতিহাস টেনে শুভাশিস সিনহা বলেন, মণিপুরের মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র যখন কাঞ্চিপুর নামের এক অঞ্চলে বাস করতেন, তখন এক রাতে তিনি স্বপ্ন দেখলেন যে শ্রীকৃষ্ণ নিকটবর্তী ভানুমুখ পাহাড়ে কাঁঠালগাছ হয়ে রাজার জন্য অপেক্ষা করছেন। পরদিনই রাজা সেই পাহাড়ে গিয়ে কাঁঠালগাছ খুঁজে পেলেন। গাছটি কেটে রাজধানীতে আনা হলো। রাজধানীর খ্যাতনামা শিল্পীকে রাজা তাঁর স্বপ্নে দেখা কৃষ্ণমূর্তির অনুকরণে কাঠের মূর্তি গড়তে আদেশ দিলেন। এই মূর্তি প্রতিষ্ঠা উপলক্ষেই তিনি ওই বছর অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লাপূর্ণিমায় মহারাসলীলা উৎসব প্রবর্তন করেন। মেয়ে বিম্বাবতীও সেই রাসে অংশ নেন। ঘটনাটি ঘটেছিল ১৭৭৯ সালে।
মাধবপুর মণিপুরি মহারাসলীলা সেবা সংঘের সহসভাপতি লক্ষ্মণ সিংহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এই উৎসব উপলক্ষে প্রায় এক মাস ধরে প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করেছি। দেশ-বিদেশ থেকে অনেক মানুষ উপস্থিত হয়েছেন। সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন ছিল উৎসবের নিরাপত্তায়।’