চৈত্রের কাঠফাটা রোদে শুকাচ্ছে কাঁচামাটির খেলনাগুলো। হাঁসফাঁস করা গরমকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেসব উল্টে-পাল্টে দেখছেন সরস্বতী পাল। একটু পর এগুলো উঠবে পাঁজায়। রোদের পর আগুনের তাপে পুড়বে মাটি। কিছুটা দূরে আগে থেকে পোড়ানো খেলনায় নানা রঙের প্রলেপ দিচ্ছেন স্বামী রণজিৎ পাল। হাতের জাদুকরিতে খেলনাগুলো হয়ে উঠেছে মোহনীয়।
ঈদের আগের দিন দুপুরে সরস্বতীদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল বিপুল কর্মযজ্ঞ। ঈদ আর নববর্ষের মেলা সামনে রেখে কাজের ধুম পড়েছে। স্বামী, সন্তান, পুত্র, পুত্রবধূ—সবাই হাত লাগিয়েছেন কাজে। মোরগ, মাছ, হাতি, ফল, সিংহ, হরিণ, তাল, কুমড়া, মাটির ব্যাংক, ফুলদানি—বিচিত্র সব মাটির পুতুলে এরই মধ্যে রং লেগেছে। কিছু পুতুলে রং লাগানো এখনো চলছে। শুকাতে দেওয়া পুতুলগুলো পোড়ানোর উপযোগী হলো কি না, সেটা তাঁরা পরীক্ষা করে দেখছেন বারবার।
সরস্বতী-রণজিৎদের বাড়ি ভৈরব নদের তীরে, দিঘলিয়ার সেনহাটি গ্রামের পালপাড়ায়। তাঁদের বাড়ির পাশের সরু পিচঢালা রাস্তার ঠিক ওপারেই ফরমাশখানা পালপাড়া। নিশ্বাস দূরত্বের এই দুই পাড়ায় কম করে হলেও ৮০টি পরিবার মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। গত তিন দশকে সংখ্যাটা ক্রমে কমেছে। অনেকে ভারতে পাড়ি দিয়েছেন। মৃৎশিল্প করা পরিবারের সংখ্যা এখন সব মিলিয়ে দশের ওপরে নয়।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে গল্প হলো রণজিৎ-সরস্বতীর সঙ্গে। মাটির পুতুল কি আর এমনি এমনি তৈরি হয়? এর জন্য দরকার এঁটেল মাটি। পানি ঢেলে সেই মাটিতে প্রথমে নরম করতে হয়। তারপর কুচাতে হয় কোদাল দিয়ে। মাটি থেকে সব ময়লা পরিষ্কার করে পা দিয়ে মাড়িয়ে তৈরি করা হয় মাটির মণ্ড। আরও কিছু প্রক্রিয়ার পর ছাঁচে পুরে তৈরি করা হয় পুতুল। এরপর শুকানোর পালা। মসৃণ করে, উল্টে-পাল্টে কয়েকবার রোদ খাইয়ে আগুনে পুড়িয়ে তৈরি হয় পুতুল। রঙের আঁচড়ে আঁচড়ে সেগুলো রূপ পায় বাহারি পুতুলে।
রণজিতের এখন ৬৮ বছর চলছে। জীবনের বড় সময় পার করেছেন খালিশপুরের পাটকলে কাজ করে। তবে পাটকলে কাজের অবসরে খেলনা আর প্রতিমা তৈরি সব সময়ই করতেন। রণজিৎ পাল জানালেন, মৃৎশিল্পের আগের সুদিন আর নেই। সবকিছুর দাম বেড়েছে। হিসাব করলে খাটুনিটুকু ফাউ। পাড়ার অনেকে দেশ ছেড়েছে। বংশপরম্পরার শিল্প তবু তাঁরা ছাড়েননি। কেউ কেউ মাটির কারুশিল্পের পাশাপাশি টিকে থাকার জন্য অন্য কাজও করছেন।
সরস্বতীর বাপের বাড়ি যশোরের বসুন্দিয়ায়। ছোটবেলা থেকেই মাটির কাজে তাঁর হাতেখড়ি। নিজ চোখে এই শিল্পের রমরমা অবস্থা দেখেছেন একসময়। এককালে মেলার আগে চার-পাঁচ দফায় মাল পোড়ানো চলত। দিয়ে শেষ করতে পারতেন না। এখন একবার পোড়া দেওয়ার মতো মালও হয় না।
সরস্বতী বলেন, ‘না করতি পারলিই ভালো হতো। কাজ ছাড়ান দেওয়ার ইচ্ছা। গাঁটির থেকেই বরং খরচ হয়ে যাচ্ছে। ছেলেরা বেসরকারি জুট মিলে কাজ করে। ছেলেরা দুই পয়সা আনে, তাই ডাল-ভাত খেয়ে আছি।
তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রণজিৎ পাল জানালেন, তিনি ২৫ হাজার টাকা পুঁজি খাটিয়েছেন। কয়েক দিন ধরে রাত তিনটার আগে ঘুমানোর সুযোগ পাচ্ছে না। কাজ শুরুও হয় খুব ভোরে। এত খাটুনি করেও ১০ হাজার টাকার বিক্রি হয়নি। বৈশাখী মেলায় নেওয়া মাল কেনার লোক কমে গেছে। বললেন, ‘অন্য কোনো কাজও শিখিনি। লাভ হোক, লোকসান হোক—এই কাজই করতি হয়।’
রণজিৎদের বাড়ি থেকে কিছুটা সামনে গোপালচন্দ্র পালদের বাড়ি। সেখানেও চলছে পুতুল তৈরি আর বেচাকেনার প্রস্তুতি। গোপালচন্দ্র পালও আগের সময়ের সুখস্মৃতি রোমন্থন করলেন। খুলনার তারের পুকুরে যে বৈশাখী মেলা বসত, সেখানে কম করে ৫০০ ডালা পুতুল বিক্রি হতো। তাঁরা সেখানে পাইকারি, খুচরা—দুইভাবেই বিক্রি করতেন। এখন একদিকে মেলা হয় কম, আবার দোকান বসাতে গেলে অনেক টাকা আগাম দিতে হয়।
গোপাল জানান, প্লাস্টিকের খেলনায় দেশ ছেয়ে যাওয়ায় তাঁদের বেচাবিক্রি কমে গেছে। মৃৎশিল্পীদের আরেক সংকট এখন মাটির আর পুঁজির। গত বছর ৬০০ টাকায় তাঁরা যতটুকু মাটি কিনেছেন, এ বছর তা কিনতে লাগছে তা ১ হাজার ২০০ টাকা। রঙের দাম বেড়েছে দুই-তিন গুণ। আগে বিনা টাকায় মাটি মিলত। জ্বালানি আর রং-খড়ির দাম কম ছিল। বেচাবিক্রিও ভালো ছিল। এখন সারাক্ষণই দুশ্চিন্তা।
পাড়ার সব মৃৎশিল্পীরই এক কথা, এক যুগ আগেও মাটির তৈরি খেলনার চাহিদা ছিল ব্যাপক। মেলার আগে তাঁদের নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড় হতো। এখন আক্রার বাজারে আর তাল মেলাতে পারছেন না। অন্য কাজ শেখেননি বলে রাতারাতি পেশা পাল্টানোরও উপায় নেই।
অভাব-অনটন আর নানা দুশ্চিন্তার মধ্যে তাঁরা তবু পূর্বপুরুষের পেশাটা টিকিয়ে রেখেছিলেন। নতুন প্রজন্মের কেউ আর এই পেশায় আসতে চাইছেন না।
গোপালচন্দ্র পাল বললেন, এটা সাত পুরুষের জাত ব্যবসা। প্রচুর খাটুনির পরও অভাব ছাড়ছে না। এই পেশার কোনো ভবিষ্যৎও দেখা যাচ্ছে না। পরিশ্রম আর ধৈর্যে কুলাবে না বলে সন্তানদেরও আর এ কাজ তাঁরা শেখাননি। তাঁরা পড়াশোনা আর চাকরিবাকরির চেষ্টা করছেন।
গোপাল বললেন, ‘আমাদের বয়সী লোকেরা চলে গেলে এই গ্রামে এই পেশা একেবারে শেষ।’