ছাদেকা খাতুনের চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েছে। শরীরে আগের মতো শক্তি নেই। এই বয়সেও প্রতিদিন কলসি কাঁখে তাঁকে যেতে হয় বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরের কৃষি মাঠে। সেখানে থাকা গভীর নলকূপ থেকে বিশুদ্ধ খাবার পানি সংগ্রহ করেন তিনি। অথচ তাঁর বাড়িতেই একটি নলকূপ আছে। ছাদেকা বেগমের বাড়ির নলকূপের মতো মেহেরপুরের একাধিক উপজেলার কয়েকটি গ্রামের নলকূপে এখন আর সুপেয় পানি পাওয়া যায় না। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এসব এলাকার বাসিন্দারা পানির তীব্র সংকটে পড়েছেন।
গত রোববার মুজিবনগর উপজেলার জয়পুর গ্রামের মসজিদের অজুখানা থেকে অন্য নারীদের সঙ্গে পানি সংগ্রহ করছিলেন ওই গ্রামের বাসিন্দা পানেজান খাতুন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এইখিনে দাড়ি থাকা সবার বাড়িতি কল আছি। কিন্তু কলে পানি নাই। আমরা গরিব মানুষ। নতুন করি কল পুততি অনেক খরচ। এতো টাকা পাবো কোতাই?’
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চার বছর ধরে মুজিবনগর উপজেলার জয়পুর, আমদহ, তারানগর, বিশ্বনাথপুর, সদর উপজেলার শালিকা, আশরাফপুর, আমদাহ, বুড়িপোতা, আলমপুর, গাংনী উপজেলার ভোলাডাঙ্গাসহ আরও কয়েকটি গ্রামে গভীর ও অগভীর নলকূপ থেকে সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পানির চাহিদা মেটাতে এলাকাবাসীকে কৃষি জমিতে স্থাপিত গভীর নলকূপের পানি সংগ্রহ করতে দূরদূরান্তে ছুটতে হচ্ছে।
জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর জানায়, আগে ভূগর্ভের ৫০ থেকে ৬০ ফুট গভীরতা থেকেই পাওয়া যেত সুপেয় পানি। গত এক দশকে ক্রমেই পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। জেলায় গভীর-অগভীর মিলিয়ে ৯ হাজার ৯১৩টি নলকূপ আছে। এর মধ্যে অকেজো হয়ে পড়ে আছে ২ হাজার ২৩৯টি নলকূপ।
জাতিসংঘের এক সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের দিক দিয়ে শীর্ষে থাকা দেশের তালিকায় এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। ‘মেকিং দ্য ইনভিজিবল ভিজিবল’ শিরোনামে জাতিসংঘের বৈশ্বিক পানি উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০২২ এর তথ্য বলছে, বাংলাদেশসহ আরও ৬টি দেশ সম্মিলিতভাবে বিশ্বের ৬০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে। বিশ্বের ৯৯ শতাংশ সুপেয় পানির উৎস হলো মাটির নিচে সঞ্চিত পানি। তবে সঠিক ধারণার অভাবে এই প্রাকৃতিক সম্পদের বেশির ভাগই অপব্যবহার হচ্ছে।
সম্প্রতি মুজিবনগর উপজেলার কয়েকটি গ্রামে গিয়ে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা সুপেয় পানির সংকটের কথা জানান। উপজেলার জয়পুর গ্রামের গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের একটি মসজিদের সামনে সুপেয় পানির জন্য সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নারীরা। ওই মসজিদে একটি গভীর নলকূপ আছে। তাঁরা শুধু খাবারের জন্য কলসিভর্তি পানি সংগ্রহ করতে পারছেন। গোসলসহ নিত্যব্যবহারের জন্য পানি নেওয়ার সুযোগ নেই এখান থেকে। সদর উপজেলার আমদাহ গ্রামের বাসিন্দা ওয়ালিদ শেখ বলেন, ‘জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে দেওয়া ৫৫০ ফুট গভীর নলকূপ বসানো হয়েছিল আমার বাড়িতে। মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে নলকূপটি থেকে আর পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এখন ৯০০ ফুট গভীর একটি নলকূপের জন্য আবেদন করেছি।’
মেহেরপুরের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সুপেয় পানির সমস্যা নিরূপণে যেসব এলাকায় সংকট সেখানে ১০টি বাড়িকে কেন্দ্র করে একটি ৯০০ ফুট গভীর নলকূপ স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে সরকার। এসব এলাকায় ৫০০টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হবে।