ভাগ্যগুণে সংসদ সদস্য হয়ে শূন্য থেকে কোটিপতি রেজাউল

সংসদ সদস্য রেজাউল করিম
ছবি: সংগৃহীত

বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসনের সংসদ সদস্য রেজাউল করিম ওরফে বাবলু ছিলেন ছিলেন একটি পত্রিকার সাংবাদিক। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি প্রথমবারের মতো স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। ওই নির্বাচনের আগে দেওয়া হলফনামায় তাঁর নিজের ও নির্ভরশীলদের মাসিক আয় ছিল মাত্র ৪১৭ টাকা।

সেই রেজাউল করিমই গত পাঁচ বছরে কোটিপতি ব্যবসায়ী বনেছেন। একসময় উপজেলা পরিষদে নির্বাচনে তিনি ১৭ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় ভোটের এক দিন আগে রাজনীতির আনকোরা রেজাউল বিএনপির সমর্থন পান। ‘খালেদা জিয়ার আসন’ হিসেবে পরিচিত ওই আসনে শেষমেশ রেজাউল ট্রাক প্রতীক নিয়ে ১ লাখ ৯০ হাজার ২৯৯ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। এতেই যেন আলাদিনের জাদুর চেরাগ হাতে পান তিনি। পাঁচ বছরেও তাঁর স্ত্রীও কোটিপতি বনেছেন।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দেওয়া হলফনামার তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে রেজাউলের নিজের ও নির্ভরশীলদের মাসিক আয় ৩ লাখ ২ হাজার ২৮ টাকা (বার্ষিক আয় ৩৬ লাখ ২৪ হাজার ৩৩৫ টাকা)। পাঁচ বছরে আয় বেড়েছে ৭২৪ গুণ। ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন বিপুল অঙ্কের টাকা। পাঁচ বছর আগে চড়তেন কম দামি পুরোনো একটি মোটরসাইকেলে। এখন চড়েন প্রায় কোটি টাকার দামি এসইউভি গাড়িতে। স্ত্রীর জন্যও কিনেছেন আরেকটি গাড়ি। পাঁচ বছর আগে ছিল না কোনো ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট। স্ত্রীর ছিল না কোনো বাড়ি। এখন রাজধানীর অভিজাত এলাকায় দামি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে রেজাউলের। স্ত্রীর আছে প্রায় কোটি টাকার বাড়ি।

বগুড়া-৭ আসনে এবার সর্বোচ্চসংখ্যক ২৫ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। এর মধ্যে ১৬ জনই স্বতন্ত্র প্রার্থী। এর মধ্যে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে ১১ স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ ১২ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। বৈধ ঘোষণা করা প্রার্থীদের মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য রেজাউল করিম ছাড়াও আওয়ামী লীগ, জাসদ, জাতীয় পার্টি (জেপি), মুক্তি জোট, এনপিপি, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বিএনএম, জাতীয় পার্টি (জেপি) ও জাকের পার্টির প্রার্থী রয়েছেন।

রাতারাতি অঢেল সম্পদের মালিক

একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পাঁচ বছর আগে রেজাউল করিম ও তাঁর নির্ভরশীলদের মাসিক আয় ছিল মাত্র ৪১৭ টাকা। বর্তমানে নিজের ও নির্ভরশীলদের মাসিক আয় ৩ লাখ ২ হাজার ২৮ টাকা। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে স্ত্রী বিউটি বেগমের এক টাকাও সঞ্চয় ছিল না। এখন বিউটি বেগম প্রায় সোয়া কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মালিক। ৫ বছর আগে রেজাউল করিমের কাছে নগদ অর্থ ছিল মাত্র ৩০ হাজার টাকা। এখন তাঁর হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। স্ত্রী বিউটি বেগমের কাছে আছে নগদ আড়াই লাখ টাকা।

পাঁচ বছর আগে রেজাউল করিম হলফনামায় উল্লেখ করেছিলেন, তাঁর বার্ষিক আয় পাঁচ হাজার টাকা। এবারের হলফনামায় নিজের ও নির্ভরশীলদের বার্ষিক আয় ৩৬ লাখ ২৪ হাজার ৩৩৫ টাকা উল্লেখ করেছেন।

সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগে পুরোনো একটি মোটরসাইকেলে চড়তেন রেজাউল করিম। এখন বিলাসবহুল দামি দুটি গাড়িতে চড়েন তিনি। একটি নিশান এক্সট্রেইল এসইউভি, অন্যটি ল্যান্ডক্রুজার। দুটি গাড়ির দাম ১ কোটি ৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।

সংসদ সদস্য হওয়ার আগে কোনো ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট ছিল না রেজাউল করিমের। এখন রাজধানীর অভিজাত এলাকায় এক হাজার বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্টের মালিক তিনি। এর দাম উল্লেখ করেছেন ১৫ লাখ টাকা। আছে সাড়ে ৪ শতাংশের অকৃষিজমি। আছে প্রায় তিন লাখ টাকার আসবাব। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগে রেজাউল করিমের স্ত্রীর কোনো বাড়ি ছিল না। এখন ১ কোটি ১ লাখ টাকার একটি বাড়ির মালিক তিনি। আছে ১০ ভরি স্বর্ণালংকার। পাঁচ বছর আগে নিজের ৬ ভরি স্বর্ণ থাকার কথা উল্লেখ করলেও স্ত্রীর কাছে কোনো স্বর্ণ ছিল না।

পাঁচ বছর আগে রেজাউল করিম হলফনামায় উল্লেখ করেছিলেন, তাঁর বার্ষিক আয় পাঁচ হাজার টাকা। হাতে নগদ ছিল ৩০ হাজার টাকা। পেশা ছিল ব্যবসা ও সাংবাদিকতা। এসএসসি পাস রেজাউল এবারের হলফনামায় নিজের পেশা ইট, বালু, সিমেন্টসহ অনলাইন ব্যবসা উল্লেখ করেছেন। নিজের ও নির্ভরশীলদের বার্ষিক আয় ৩৬ লাখ ২৪ হাজার ৩৩৫ টাকা উল্লেখ করেছেন। এখন মাসে আয় ৩ লাখ ২ হাজার ২৮ টাকা। এই হিসাবে তাঁর আয় বেড়েছে ৭২৪ গুণের বেশি।

পাঁচ বছর আগে আয়ের উৎস ছিল কৃষি ও ব্যবসা। এর মধ্যে কৃষি খাত থেকে বছরে আয় তিন হাজার টাকা। আর ব্যবসা থেকে বছরে দুই হাজার টাকা আয় ছিল তাঁর। ব্যাংকে ছিল মাত্র ৩০ হাজার টাকা। পুরোনো মোটরসাইকেলের মূল্য ছিল ৫০ হাজার টাকা। এখন গাড়ি ছাড়াও আছে তিন লাখ টাকা মূল্যের দামি মোটরসাইকেল। এবার কৃষি খাত থেকে আয় নেই উল্লেখ করলেও বাসা ও দোকানভাড়া থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা আয়ের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। ব্যাংকের সঞ্চয়পত্র থেকে বার্ষিক আয় ৫ হাজার ১১০ টাকা। ব্যবসায় বিনিয়োগ আছে প্রায় সোয়া ১১ লাখ টাকা। ইট, বালু, সিমেন্ট ও অনলাইন ব্যবসা থেকে বছরে আয় ১১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। সংসদ সদস্য হিসেবে প্রাপ্ত আয় ও আনুতোষিক ২৩ লাখ ২৪ হাজার ২২৫ টাকা।

স্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে পাঁচ বছর আগে তাঁর কৃষিজমির পরিমাণ ছিল ৪৫ শতক। এবার তিনি কৃষিজমির কথা উল্লেখ করেননি। সংসদ সদস্য হওয়ার আগে তিনি অকৃষিজমির আর্থিক মূল্য উল্লেখ করেছিলেন ৪৫ লাখ টাকা। এবারের হলফনামায় তিনি বলেছেন, তার ৩৫ হাজার টাকা মূল্যের অকৃষিজমি রয়েছে।

পাঁচ বছর আগে নিজের নামে পাঁচ লাখ টাকার দালান ছিল। এবার অবশ্য সে দালান নেই উল্লেখ করেছেন হলফনামায়। স্ত্রীর নামে ১ কোটি ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার আবাসিক ভবন থাকার কথা বলেছেন হলফনামায়। পাঁচ বছর আগে স্ত্রী বিউটি বেগমের নামে কোনো আবাসিক দালান ছিল না।

তবে রেজাউল করিম বলেন, ‘নির্বাচনী এলাকায় ৩১টি সেতু নির্মাণ করেছি, ৩৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একাডেমিক ভবন নির্মাণ করে দিয়েছি। ১১২ কিলোমিটার রাস্তা পাকা করেছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিও বাণিজ্য, উন্নয়ন প্রকল্পে কমিশন নিয়েছি বলে যাঁরা অপপ্রচার চালাচ্ছেন, তাঁরা আমার কাছে নানাভাবে অনৈতিক সুবিধা নিতে এসে ব্যর্থ হয়েছেন। ফায়দা লুটতে না পেরেই তাঁরা এখন আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন।’

অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে দুদক

সংসদ সদস্য রেজাউল করিমের অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জনের তথ্য পেয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধানে নামে দুদক। পরে বগুড়া আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে ২০২১ সালের ১৪ মার্চের মধ্যে তাঁকে সম্পদের প্রাথমিক হিসাব দাখিল করতে বলা হয়। ওই বছর ২৩ জুন তিনি সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। বর্তমানে বিষয়টি দুদকের অনুসন্ধান নথিতেই আছে।

দুর্নীতি করে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অস্বীকার করে রেজাউল করিম বলেন, ‘দুর্নীতি করিনি। যা করেছি, সরকারকে বৈধ ট্যাক্স-ভ্যাট দিয়েই করেছি। দুদক সম্পদ বিবরণী চেয়ে নোটিশ দিয়েছিল, তা দাখিল করেছি। যত দূর জানি, নিষ্পত্তি হয়েছে।’

স্থানীয় ভোটাররা বলছেন, পাঁচ বছর সংসদ সদস্য থাকলেও নির্বাচনী এলাকায় খুব একটা আসেননি রেজাউল করিম। উল্টো উন্নয়ন প্রকল্প কেনাবেচা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিও লেটার বাণিজ্য, পিস্তল হাতে তোলা ছবি ফেসবুকে দিয়ে ভাইরাল হওয়া, নারী স্বাধীনতার বিরোধিতা করে সংসদে বক্তব্য দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়াসহ নানা কারণে বিতর্কিত হয়েছেন।