লালমাই পাহাড়ের ঢালে চা চাষে সম্ভাবনার হাতছানি

কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে গড়ে উঠেছে চা-বাগান। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বড় ধর্মপুর এলাকায়
ছবি: এম সাদেক

কুমিল্লা-নোয়াখালী সড়কের পশ্চিম পাশে রতনপুর বাজার। সেখান থেকে পশ্চিম দিকে পাকা সড়ক ধরে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি জনপদ। দুই পাশে পাহাড় আর টিলা। নৈসর্গিক মনোলোভা পরিবেশ। সড়কের পূর্বপাশে সরু সড়ক ধরে ২০০ গজ এগোলেই নজরে পড়বে চা-গাছের সবুজ পাতা। গাছের মধ্যে নতুন কুঁড়ি। শ্রমিকেরা বাগান থেকে পাতা তুলছেন। কেউ বাগানে পানি ছিটাচ্ছেন।

কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে এই চা চাষ শুরু করেছেন একজন উদ্যোক্তা। সদর দক্ষিণ উপজেলার বারপাড়া ইউনিয়নের বড় ধর্মপুর এলাকার এক একর জায়গার উঁচুনিচু টিলা ও টিলার ঢালে পরীক্ষামূলক চা চাষ হচ্ছে। বাগান থেকে পাতা সংগ্রহও শুরু হয়েছে। ‘মজুমদার চা-বাগান’ নামের এ বাগানে প্রতিদিন পর্যটক ও ভ্রমণপিপাসুরাও ঘুরতে আসছেন।

বাগানের স্বত্বাধিকারী মো. তারিকুল ইসলাম মজুমদার। ২০২১ সালে তিনি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার চা-বাগানের মালিক এক বন্ধুকে লালমাই পাহাড়ে আমন্ত্রণ জানান। পাহাড়ের লালমাটি ও পরিবেশ দেখে তিনি মত দেন, এখানে চা-বাগান গড়ে তোলা সম্ভব। এরপর তারিকুল মৌলভীবাজার থেকে ৪৫ টাকা দরে ছয় হাজার বিটি-২ প্রজাতির গাছের চারা এনে এক একর জায়গায় রোপণ করেন।

লালমাই পাহাড়ের মাটি চা-চাষের জন্য উপযোগী। কিন্তু চায়ের চারা করার জন্য উপযোগী নয়। তাই শ্রীমঙ্গল থেকে চারা আনা হয়। এখানকার মাটি বেশি লাল ও বেলে ধরনের।
রাজু তাঁতী, মজুমদার চা-বাগানের তত্ত্বাবধায়ক

বাগানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চা-গাছ রোপণের পর তারিকুল ইসলাম দেখতে পান এই এলাকায় বৃষ্টি কম হচ্ছে। এতে গাছগুলো বড় হচ্ছে কম। একপর্যায়ে তিনি বাগানে নলকূপ বসান। এরপর বাগানে পানি দেওয়া শুরু করেন। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চা-পাতা তোলার কাজ শুরু করেন। প্রতি ১৫ দিন অন্তর চা-পাতা তোলা হয়। এতে প্রথম ধাপে ৫০০ কেজি চা-পাতা তোলা হয়। এ পর্যন্ত সাড়ে ছয় হাজার কেজি চা-পাতা উত্পাদিত হয়েছে। তবে পরিমাণে কম হওয়ায় সেগুলো বস্তায় ভরে গুদামে রাখা হয়েছে। পরে এগুলো প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে ‘গ্রিন টি’ তৈরি করা হবে।

এ পর্যন্ত সাড়ে ছয় হাজার কেজি চা-পাতা উত্পাদিত হয়েছে মজুমদার চা–বাগানে

চা-বাগানের সামনে গত শুক্রবার বিকেলে কথা হয় বড় ধর্মপুর এলাকার বাসিন্দা হাসান আলীর (৬০) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘একসময় এখানে শেয়ালের ডাক শোনা যেত। নানা ধরনের জীবজন্তু থাকত। এখন পাহাড়ের ঢালে ঢালে চা-গাছ। দেখতেই ভালো লাগে।’

চা-বাগানের তত্ত্বাবধায়ক রাজু তাঁতী। তিনি একসময় শ্রীমঙ্গলের বিলাসছড়া চা-বাগানে বংশপরম্পরায় কাজ করতেন। বাংলাদেশ চা বোর্ডের মাধ্যমে তাঁকে লালমাই পাহাড়ে নিয়ে আসেন তারিকুল ইসলাম। সঙ্গে রাজুর স্ত্রী দিপালী তাঁতী, মেয়ে দিপর্না তাঁতী ও ছেলে দীপ্ত তাঁতীও আসেন। তাঁদের থাকার জন্য বাগানের মধ্যে মাটির ঘর করে দেওয়া হয়। রাজু ও তাঁর স্ত্রী চা-বাগানের পরিচর্যা করেন। গাছগুলো বেড়ে ওঠার জন্য কাটিং থেকে শুরু করে সব কাজ করেন স্বামী-স্ত্রী। তাঁদের সহযোগিতা করেন আরও সাতজন শ্রমিক।

ছোটবেলা থেকেই চা-বাগানে কাজ করে আসা রাজু তাঁতী বলেন, মজুমদার চা-বাগানে উন্নতমানের চা-গাছ বিটি-২ লাগানো হয়েছে। গত মার্চে নতুন করে আরও জায়গা নিয়ে পাঁচ হাজার চারা লাগানো হয়েছে। এখন এগুলোর পরিচর্যা চলছে। লালমাই পাহাড়ের মাটি চা-চাষের জন্য উপযোগী। কিন্তু চায়ের চারা করার জন্য উপযোগী নয়। তাই শ্রীমঙ্গল থেকে চারা আনা হয়। এখানকার মাটি বেশি লাল ও বেলে ধরনের। মাটিতে আর্দ্রতার পরিমাণ কম। এরপরও এখানে চা হবে। বর্তমানে যে পাতা তোলা হয়েছে, তা দিয়ে ‘গ্রিন টি’ হবে।

বৃষ্টিপাতের পরিমান কম হওয়ায় নলকূপের মাধ্যমে সেচ দেওয়া হয় এই চা–বাগানে

উদ্যোক্তা তারিকুল ইসলাম মজুমদার বলেন, কমলগঞ্জের একটি খাসিয়াপুঞ্জির মন্ত্রী জিডি সানের পরামর্শে ২০২১ সালে এক একরের বেশি পাহাড়ে চা-বাগান করেন। এখন আরও পাঁচ একর জায়গায় চায়ের চারা রোপণ করা হবে। পানির অভাব এখানে। বৃষ্টি কম। এটা ছাড়া তেমন ঝামেলা নেই। পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করেছেন। শিগগিরই চা-পাতা প্রস্তুতের জন্য জাপান থেকে মেশিন এনে স্থাপন করা হবে।

কুমিল্লা জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, লালমাই পাহাড়ের প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র চা-বাগান এটি। এখানে বৃষ্টির পরিমাণ কম। বাগানের স্বত্বাধিকারী কৃত্রিমভাবে চা-গাছে পানি দিচ্ছেন। এতে করে গাছগুলো টিকে আছে। চা-বাগানের জন্য বৃষ্টি ভালো। কুমিল্লা অঞ্চলে বৃষ্টি কম হচ্ছে। তবু পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছে চা চাষ। এখানকার পাতা থেকে গ্রিন টি হতে পারে।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, লালমাই পাহাড়ের মাটি, পরিবেশ নিয়ে আগে পরীক্ষা করতে হবে। সেখানে টেকসই বাগান করতে হলে করণীয় কী, তা ঠিক করা হবে। ইতিবাচক কোনো কিছু পেলে চা বোর্ড আগ্রহী চা-বাগান করা ব্যক্তিদের সহায়তা করবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা জেলার সভাপতি মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘লালমাই পাহাড়ে চা-বাগান হলে অন্তত পাহাড়টা টিকে থাকবে। তারিকুলের এই উদ্যোগ লালমাই পাহাড়কে রক্ষা করবে। টিলা কেটে এমনিতেই সাবাড় করে ফেলেছেন মাটিখেকোরা। এখন এই পাহাড়ে চা চাষ আমাদের জন্য সুখবরই বটে। আরও উদ্যোক্তারা এখানে চা-বাগান করুন। মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ ও চট্টগ্রামের পর পঞ্চগড়ে চা-বাগান হয়েছে। কুমিল্লার মাটি ভালো। পরীক্ষা করে এখানে চা-বাগান হতে পারে। চা অর্থকারী ফসল।’

ধর্মপুর এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা চিকিত্সক এ বি এম খোরশেদ আলম বলেন, তারিকুল স্বপ্নবাজ মানুষ। এলাকায় ব্যতিক্রমধর্মী কাজ করেন। এর আগে জাপানের অর্থায়নে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্কুল করেন। খোলামেলা পরিবেশে তিনতলা স্কুলে শিক্ষার্থী পড়ছে। স্কুলের পাশেই চা-বাগান। মনোলোভা এক পরিবেশ। তাঁর এ উদ্যোগ এলাকার জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে।