খুলনা সিটির ওয়ার্ড পরিক্রমা

পানির কষ্ট, মাদকের আখড়া 

খুলনা নগরের বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস ও বেসরকারি ডকইয়ার্ড এই দুই ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে।

খুলনার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের ৭ নম্বর ঘাট বস্তিতে অনেকগুলো নলকূপ থাকলেও শুষ্ক মৌসুমের চার মাস তাতে পানি পাওয়া যায় না। তখন পাম্প দিয়ে পানির ব্যবস্থা করতে হয়। তা–ও বিকল হলে ভোগান্তির অন্ত থাকে না। গত ২৭ এপ্রিল তোলা
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

খুলনা নগরের ৭ নম্বর কাস্টমস ঘাট এলাকার পশ্চিম দিকে চলে গেছে একটি সরু গলি। গলির উত্তর পাশে এরশাদ আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অন্য পাশে ছোট ছোট টিনের ঘর। এলাকাটি গ্রিনল্যান্ড আবাসন হিসেবে পরিচিত। মূলত এটি রেলওয়ের জমিতে গড়ে ওঠা বস্তি। খুলনা মহানগরের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত এলাকাটি। এলাকাটি একসময় নিয়ন্ত্রণ করতেন কুখ্যাত খুনি হিসেবে পরিচিত এরশাদ শিকদার। বস্তির ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য বিদ্যালয় তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 

বিদ্যালয়ের শেষ সীমানায় একটি দেয়ালের সঙ্গে স্থাপন করা আছে কয়েকটি পানির ট্যাপ। গত ২৬ এপ্রিল দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, মোটর নষ্ট থাকায় তা দিয়ে পানি পড়ছে না। তবে সেখানে পানি নিতে কলস নিয়ে আসছেন বস্তির নারীরা। পানি না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন তাঁরা।

এই ওয়ার্ডে অধিকাংশ ভাসমান মানুষের বসবাস ও ঘোরাফেরা। এ কারণে মাদক নির্মূল করা কঠিন। বস্তিবাসীর পানির সমস্যা নিরসনের জন্য কয়েকটি পাম্প স্থাপন করে দেওয়া হয়েছে। পুনরায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হলে রকেট ঘাট থেকে ফরেস্ট ঘাট পর্যন্ত নদীর পাড় বাঁধাই করে সেখানে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
মো. শামসুজ্জামান মিয়া, বর্তমান কাউন্সিলর, খুলনা সিটির ২১ নম্বর ওয়ার্ড

স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, ওই আবাসনের মধ্যে ওয়াসার পানির কোনো সংযোগ নেই। বহু আগে সিটি করপোরেশন থেকে কিছু নলকূপ স্থাপন করে দিয়েছিল, কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে ওই নলকূপ দিয়ে পানি ওঠে না। এ কারণে এলাকার মানুষের পানির কষ্ট লাঘবের জন্য কয়েকটি এনজিও সেখানে পাঁচটির মতো পাম্প স্থাপন করে বস্তির মানুষের খাওয়ার ও ব্যবহারের পানির চাহিদা পূরণ করেছে। প্রায় ১৫ ঘণ্টা এসব মোটর চলতে থাকে। মাঝেমধ্যে বিকল হয়ে গেলে বিপাকে পড়েন মানুষ।

ওই বস্তিতে ৯ হাজারের বেশি মানুষের বসবাস। পরিবার রয়েছে ২ হাজারের বেশি। প্রায় সবাই শ্রমজীবী ও ভাসমান মানুষ। এলাকাবাসী জানান, কয়েক বছর ধরে ওই এলাকায় মাদকের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। মাদক ব্যবসায়ীদের চাপে এলাকার মানুষ সব সময় তটস্থ থাকেন।

খুলনার নগরের ২১ ও ২২ নম্বর ওয়ার্ড দুটি ভৈরব নদ ও রূপসা নদীর কূল ঘেঁষে গড়ে ওঠা। খুলনা নগরের বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস ও বেসরকারি ডকইয়ার্ড ওই দুই ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে।

২১ নম্বর ওয়ার্ডটির জনসংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি। ভোটার প্রায় ২০ হাজার। ওই ওয়ার্ডের পূর্ব দিকে ফরেস্ট ঘাট রোড ও ২২ নম্বর ওয়ার্ড। পশ্চিমে ৭ নম্বর ঘাট রোড ও জোড়াগেট কাঁচাবাজার, উত্তর-পূর্বে ভৈরব নদ এবং দক্ষিণে আপার যশোর রোড। খুলনা রেলওয়ে স্টেশন, বড় বাজার, খুলনা সার্কিট হাউস, আদালত, জেলা কারাগার, ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল (সদর) হাসপাতাল, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জেলা স্টেডিয়াম, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, সিটির প্রধান ডাকঘর, টিঅ্যান্ডটি অফিস, বাংলাদেশ ব্যাংক, উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি, শিশু হাসপাতাল, জেলা রেজিস্ট্রি অফিস, জেলা পরিষদ, নগর ভবন, শহীদ হাদিস পার্ক, সদর থানা, পিকচার প্যালেস, বিআইডব্লিউটিএ, রকেট ঘাট, খুলনা ওয়াসার কার্যালয়সহ রয়েছে বহু ব্যাংক, বিমা, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

এই ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অনেক জায়গায় নালার অবস্থা খুবই নাজুক। জলাবদ্ধতা নিরসনে নতুন প্রকল্পের কাজ চলছে অনেক এলাকায়। ওয়াসার পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থার জন্য সড়ক খোঁড়াখুঁড়িও দেখা যায়। বেশির ভাগ জায়গায় খুঁড়ে রাখা সড়ক সংস্কার করা হয়নি। নদীর তীরবর্তী হওয়ায় জলাবদ্ধতা কম। অন্যান্য ওয়ার্ডের মতোই মশার উপদ্রব, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ একই ধরনের কিছু সমস্যা ওই ওয়ার্ডেও রয়েছে। তবে তুলনামূলক বেশ পরিচ্ছন্ন। ঘাট এলাকায় মাদক আর কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত সবচেয়ে বেশি।

২১ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর মো. শামসুজ্জামান মিয়া। তিনি খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক। পরপর তিনবার নির্বাচিত কাউন্সিলর তিনি। এলাকার বিভিন্ন সমস্যার ব্যাপারে জানতে চাইলে শামসুজ্জামান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, একসময় ২১ নম্বর ওয়ার্ড খুব অনুন্নত ছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে প্রায় ৮০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ করা হয়েছে, এখনো কাজ চলছে। এই ওয়ার্ডে অধিকাংশ ভাসমান মানুষের বসবাস ও ঘোরাফেরা। এ কারণে মাদক নির্মূল করা কঠিন। তবে প্রতিটি এলাকায় মাদকবিরোধী কমিটি করে দেওয়া হয়েছে।

গ্রিনল্যান্ড আবাসন বস্তির ব্যাপারে শামসুজ্জামান মিয়া বলেন, ওই বস্তিবাসীর পানির সমস্যা নিরসনের জন্য কয়েকটি পাম্প স্থাপন করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি অলিগলি কংক্রিটের ঢালাই দেওয়া হয়েছে।

পুনরায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হলে রকেট ঘাট থেকে ফরেস্ট ঘাট পর্যন্ত নদীর পাড় বাঁধাই করে সেখানে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করার পরিকল্পনা করছেন কাউন্সিলর শামসুজ্জামান। 

অন্যদিকে ২২ নম্বর ওয়ার্ডের জনসংখ্যা ২৫ হাজারের মতো। ভোটার রয়েছেন প্রায় ১৭ হাজার। এর উত্তর ও পূর্বে রূপসা নদী, দক্ষিণ-পশ্চিমে ২৯ নম্বর ওয়ার্ড এবং পশ্চিমে ২১ নম্বর ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডের মধ্যে রয়েছে নতুনবাজার লঞ্চঘাট, কাস্টমস ঘাট, রূপসা ঘাট, খুলনা জিলা স্কুল, জেলা প্রশাসকের বাসভবন, পুলিশ সুপারের বাসভবন, খুলনা টাউন জামে মসজিদ, সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের কার্যালয়, খুলনা ক্লাব, অফিসার্স ক্লাব, আযমখান সরকারি কমার্স কলেজ, সরকারি মডেল স্কুল, খুলনা পঙ্গু হাসপাতাল, খুলনা পুলিশ লাইনস, খুলনা পরিসংখ্যান অফিসসহ রয়েছে বহু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

২২ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর কাজী আবুল কালাম আজাদ। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য। গতবারই প্রথম কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। এলাকার বিভিন্ন সমস্যার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একসময় মাদকের ব্যাপক বিস্তার হয়েছিল, এখন সেটা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সপ্তাহে অন্তত দুইবার মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় নলকূপগুলো কাজ করছে না। এ কারণে গত দুই বছর শুষ্ক মৌসুমে মানুষের কিছুটা কষ্ট বেড়েছে। পুনরায় নির্বাচিত হলে পানির সমস্যা নিরসন, ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় ও কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ করার পরিকল্পনা করছেন তিনি।