মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলায় পূর্ববিরোধকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে পুলিশের সামনে ৮ এপ্রিল খুন হন আওয়ামী লীগ নেতা মো. সোহরাব খান। এ ঘটনার আট দিন পেরিয়ে গেছে। অথচ এখনো থানায় কোনো মামলা হয়নি।
নিহতের স্বজনদের অভিযোগ, আট দিন ধরে মামলা করতে থানায় একাধিকবার চক্কর কেটেছেন তাঁরা। তবে পুলিশ মামলা না নিয়ে থানা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে। তবে পুলিশ বলছে, নিহতের স্বজনদের মামলা দিতে অনুরোধ করা হলেও তাঁরা কেউ আসেননি। এ জন্য মামলা হয়নি।
নিহত সোহরাব খান উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সদস্য ছিলেন। তাঁর বাড়ি উপজেলার মূলচর এলাকায়। ওই ঘটনায় তাঁর ছেলে জনি খানও (৩০) আহত হয়েছেন। জনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
নিহতের ছোট ভাই মিজান খান আজ সোমবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ভাই হত্যায় অন্য আসামিদের সঙ্গে দিঘিরপাড় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আরিফ হালদার, তাঁর ভাই খুকু হালদার এবং তাঁদের চাচা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কবির হালদাররাও জড়িত। ভাইয়ের লাশ দাফনের পর থেকে প্রতিদিন আমরা মামলা করার জন্য টঙ্গিবাড়ী থানায় গিয়েছি। আমাদের লিখিত অভিযোগটি মামলা হিসেবে নিতে অনুরোধ করেছি। অভিযোগে আরিফ হালদারদের নাম থাকায় থানা-পুলিশ মামলা না নিয়ে বারবার ফিরিয়ে দিয়েছে।’
মিজান খানের দাবি, দিঘিরপাড় তদন্তকেন্দ্রের পুলিশ পরিদর্শক মো. শাহ আলমের সামনে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ন্যায়বিচারের আশায় মামলায় পুলিশের নাম দিতে চাননি। তারপরও পুলিশ অজানা কারণে তাঁদের মামলাটি নেয়নি। তিনি ভাই হত্যার বিচার চান।
মামলা না নেওয়ার অভিযোগটি সত্য নয় বলে দাবি টঙ্গিবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোল্লা মো. সোয়েব আলীর। তিনি বলেন, নিহতের স্বজনদেরর কেউ থানায় সেভাবে কোনো লিখিত অভিযোগ নিয়ে আসেননি। তাই এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি।
নিহতের স্বজনেরা দাবি করছেন, তাঁরা লিখিত অভিযোগ নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু পুলিশ আরিফ হালদারসহ কয়েকটি নাম বাদ দিয়ে অভিযোগ দিতে বলেছে। এ ব্যাপারে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, অভিযোগটি সঠিক নয়।
পরিবার মামলা করতে আসেনি, এটা সত্য হলে পুলিশ কেন মামলা করেনি, জানতে চাইলে ওসি মোল্লা মো. সোয়েব আলী বলেন, ‘আমরা তাঁদের অনুরোধ করেছি, ঘটনার সঙ্গে যাঁরা প্রকৃতভাবে জড়িত, তাঁদের নামে যেন অভিযোগ দেন। তাঁরা অভিযোগ দিলে আমরা মামলাটি নিয়ে নেব।’
পুলিশের যে কর্মকর্তার সামনে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি ঘটল, তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি একজন পুলিশ পরিদর্শক। আমি একজন পুলিশ পরিদর্শক। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। তবে শাহ আলম ঘটনার সঙ্গে জড়িত কি না, বিষয়টি যাচাই করা হচ্ছে।’
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় মানুষেরা বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাব খানের ছেলে জনি খান দিঘিরপাড় ইউপির সাবেক সদস্য আসলাম হোসেন ওরফে ভোলার ছেলে রিজভীর কাছে এক লাখ টাকা পেতেন। এ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে বিরোধ চলছিল। এ বিষয়ে ৮ এপ্রিল সোমবার সকালে উভয় পক্ষের সালিসে বসার কথা ছিল। সেদিন সকালে আসলাম খানের দুই ছেলে রিয়াম হালদার, রিজভী হালদার ও তাঁদের সহযোগীরা দিঘিরপাড় তদন্তকেন্দ্রে আসেন। দুপুর ১২টার দিকে সোহরাব খান ও তাঁর ছেলে জনিকে ডেকে আনেন পুলিশের পরিদর্শক মো. শাহ আলম।
সোহরাব খান তদন্তকেন্দ্রের দরজার সামনে আসতেই রিজভী ও তাঁর সহযোগীরা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। রিজভীরা পুলিশের সামনেই সোহরাব খান ও তাঁর ছেলে জনিকে মারধর শুরু করেন। মারতে মারতে তদন্তকেন্দ্রের মাঠে নিয়ে যান। একপর্যায়ে তাঁরা সোহরাব খান ও জনিকে ছুরিকাঘাত করেন। পরে স্থানীয় লোকজন তাঁদের উদ্ধার করে টঙ্গিবাড়ী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে সোহরাব খানকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
সেদিন ঘটনার পর বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত তদন্তকেন্দ্রের সামনে উত্তেজিত জনতা অবস্থান নেন। কার্যালয়ের ভেতর পরিদর্শক মো. শাহ আলমকে অবরুদ্ধ রাখেন। স্থানীয় মানুষেরা তাঁর শাস্তি দাবি করেন। পরে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে মুন্সিগঞ্জ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমন দেবের নেতৃত্বে দুই শতাধিক পুলিশ প্রহরায় সেখান থেকে শাহ আলমকে বের করে কয়েকটি গাড়ির মাধ্যমে নিরাপত্তা দিয়ে মুন্সিগঞ্জে আনা হয়।
এই ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ লুৎফর রহমান আক্ষেপের সঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিহতের স্বজনেরা আমার কাছে এসেছিলেন। আমি তাঁদের কাছে ঘটনা শুনেছি। একটা মানুষকে হত্যা করা হলো। তাঁর স্বজনেরা বিচারের জন্য থানায় মামলা করতে গেলেন। পুলিশ সেখানে বেঁধে দিচ্ছে কাকে আসামি করা যাবে, কাকে আসামি করা যাবে না। শেষ পর্যন্ত থানায় মামলাটাও পুলিশ নিল না। একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক দেশে এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না।’
এ সম্পর্কে মুন্সিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমন দেব বলেন, একটা মানুষ মারা গেছেন। সেখানে অবশ্যই মামলা হবে। হয়তো বাদীপক্ষ কোনো বিষয় নিয়ে ভুল-বোঝাবুঝির মধ্যে আছেন। প্রকৃত দোষীদের নাম উল্লেখ করে পুলিশ মামলা নেবে। পরিদর্শক শাহ আলমের সামনে হত্যার ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, তাঁর বিষয়ে তদন্ত করতে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত চলছে। তদন্ত প্রতিবেদনের পর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।