চেয়ারম্যানকে জখমের ২৪ ঘণ্টা পরও মামলা হয়নি, হামলাকারী ছিলেন ১১ জন

জাহিদুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

নওগাঁর রানীনগর উপজেলার পারইল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহিদুর রহমানকে তাঁর কার্যালয়ে ঢুকে কুপিয়ে জখমের ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও থানায় মামলা হয়নি। হামলাকারীদের কাউকে আটকও করতে পারেনি পুলিশ। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১১ জন ইউপি চেয়ারম্যানের ওপর হামলা চালান।

গতকাল রোববার বেলা ১১টার দিকে হেলমেট ও মাস্ক পরে দুর্বৃত্তরা কার্যালয়ে ঢুকে ইউপি চেয়ারম্যান জাহিদুর রহমানকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে পালিয়ে যান। ইউপি চেয়ারম্যান বর্তমানে ঢাকায় জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন। জাহিদুর রানীনগর উপজেলা যুবদলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক।

রানীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু ওবায়েদ বলেন, এখন পর্যন্ত হামলার ওই ঘটনায় থানায় কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। তবে হামলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।

আজ সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পারইল ইউপি কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ইউপি কার্যালয়ের চত্বর থেকে ভবনের বারান্দায় ওঠার সিঁড়িতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনের বারান্দাতেও রক্তের দাগ। কক্ষের ভেতরে চেয়ারগুলো এলোমেলো। পড়ে আছে চেয়ারম্যানের ব্যবহৃত জুতা। কক্ষের ভেতরে মেঝেতে বিভিন্ন জায়গায় রক্তের চিহ্ন।  

চেয়ারম্যানের ওপর হামলার ঘটনার সময় কার্যালয়ে ছিলেন ইউপি কার্যালয়ের সচিব তরিকুল ইসলাম, হিসাব সহকারী বিমান চন্দ্র সাহা, ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্রের উদ্যোক্তা মো. রনি, গ্রাম পুলিশ সদস্য গোলাপ, রামকৃষ্ণ ও মজিবর। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার কিছু পরে হামলাকারীরা মাস্ক ও হেলমেট পরে কার্যালয়ে ঢোকেন। হামলাকারীরা প্রথমে ইউপি সচিব ও কার্যালয়ের অন্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ধারালো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেন। এরপর তাঁরা চেয়ারম্যানের কক্ষে ঢুকে জিআই পাইপ ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে চেয়ারম্যানের ওপর হামলা চালান। দেড় থেকে দুই মিনিট পর হামলাকারীরা মোটরসাইকেল নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান। মুখে মাস্ক ও হেলমেট পরে থাকায় কাউকে চিনতে পারেননি তাঁরা। তবে কার্যালয়ের ভেতরে–বাইরে সব মিলিয়ে ১১ জনের মতো হামলাকারী ছিলেন।

ঘটনার এক দিন পরও ইউপি সচিব তরিকুল ইসলামের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। হামলার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, গতকাল ইউপি কার্যালয়ে গ্রাম আদালতে দুটি মামলার শুনানি হওয়ার কথা ছিল। চেয়ারম্যান সে জন্য সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কার্যালয়ে আসেন। চেয়ারম্যান আসার কিছু পরে কয়েকটা কাগজে স্বাক্ষর করাতে তিনি চেয়ারম্যানের কক্ষে যান। ওই সময় ইউনিয়নের বরগাছা গ্রামের একজন লোক তাঁর বাবার মৃত্যুসনদ নেওয়ার জন্য চেয়ারম্যানের রুমে বসেছিলেন। এর কিছুক্ষণ পরই মুখে মাস্ক পরা একজন লোক রুমে ঢুকে মৃত্যুসনদ নিতে আসা ওই লোককে বলেন, ‘চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমার পারসোনাল (ব্যক্তিগত) কথা আছে। আপনি একটু পরে আসেন।’

ওই লোক বের হয়ে গেলে মুখে মাস্ক ও হেলমেট পড়া আরও দুজন লোক রুমে ঢুকে তাঁকে (তরিকুল) চাকু দেখিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। তখন তিনি ভয়ে সেখান থেকে বের হয়ে দৌড়ে ইউপি কার্যালয়ের মূল গেট দিয়ে চলে যান। দেড়-দুই মিনিট পর লোকগুলা বের হয়ে মোটরসাইকেলে করে চলে যান।

হিসাব সহকারী বিমান চন্দ্র সাহা বলেন, তাঁর কক্ষের সামনে দিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে যাওয়ার সময় দুজন লোক চাকু দেখিয়ে তাঁকে বলেন, ‘এখান থেকে যাবু, না ম্যারে দিমু।’ পরিস্থিতি খারাপ দেখে তিনি কার্যালয় থেকে বের হয়ে যান। বের হওয়ার সময় কার্যালয়ের সামনে চারটি মোটরসাইকেল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। দুই মিনিট পর হামলাকারীরা মোটরসাইকেলে উঠে উপজেলার আবাদপুকুর বাজারের দিকে চলে যান। হামলাকারীরা পালিয়ে যাওয়ার সময় চেয়ারম্যানের কক্ষে একটি জিআই পাইপ ফেলে রেখে গেছেন।

ইউপি কার্যালয়ের সামনে দিয়ে যাওয়া আদমদীঘি-আবাদপুকুর সড়কে সংস্কারের কাজ করা হচ্ছে। সোমবার দুপুরে ১৫-১৬ জনকে ইউপি কার্যালয় থেকে প্রায় ১০০ মিটার দূরে সড়ক সংস্কারের কাজ করতে দেখা যায়। শ্রমিকেরা বলেন, রোববার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে চারটি মোটরসাইকেলে করে ১১ জন লোক ইউপি কার্যালয়ের সামনে এসে দাঁড়ান। হামলাকারীদের মধ্যে শুধু একজনের মুখে কোনো মাস্ক ও হেলমেট ছিল না। মাস্ক ও হেলমেট ছাড়া ওই ছেলে ১৮-২০ বছর বয়সী। অন্যদের কারও মাথায় হেলমেট ও কারও মুখে মাস্ক পরা ছিল। মোটরসাইকেল থেকে নেমেই হামলাকারীরা তাঁদের ইউপি কার্যালয়ের সামনে থেকে সরিয়ে দেন।

এক শ্রমিক বলেন, মোটরসাইকেল করে আসা লোকজন নিজেদের সংসদ সদস্যের লোক বলে পরিচয় দেন। কাজ ভালো হচ্ছে না বলে তাঁদের (শ্রমিকদের) কাজ বন্ধ করে দিতে বলেন। একপর্যায়ে তাঁদের শাসিয়ে ইউপি কার্যালয়ের সামনে থেকে সড়কের উত্তর দিকে তাড়িয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর শোরগোল শুনে ছুটে এসে শোনেন, মোটরসাইকেল নিয়ে আসা লোকগুলো চেয়ারম্যানকে কুপিয়ে চলে গেছেন।

নওগাঁর পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রাশিদুল হক বলেন, ইউপি চেয়ারম্যানকে কুপিয়ে জখম করার ঘটনাকে গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে। কারা কী উদ্দেশ্যে এই হামলা চালিয়েছেন, তা শনাক্তের চেষ্টা চলছে। এগুলো ব্যক্তিগত রেষারেষি না কোনো সংঘবদ্ধ চক্রের কাজ, এসব বিষয় খতিয়ে দেখছেন তাঁরা।