দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে চলমান ধর্মঘটের নবম দিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সড়ক অবরোধ করেন চা-শ্রমিকেরা। বাগানে বাগানে চলছে সভা-সমাবেশ।
গতকাল শনিবার বিকেলে সরকারের ১৪৫ টাকা মজুরি নির্ধারণের প্রস্তাব মেনে নিয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছিলেন চা-শ্রমিকনেতারা। কিন্তু সাধারণ শ্রমিকেরা সেই সিদ্ধান্ত মানেননি।
সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করে শ্রমিকনেতাদের ধর্মঘট প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়েছিল বলে দাবি করেন সাধারণ শ্রমিকেরা। এ ঘটনায় চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও সরকারের ওপর চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করেন সাধারণ শ্রমিকেরা। শ্রমিকনেতারা বলছেন, শ্রমিকেরাই যেহেতু তাঁদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে নেতা বানিয়েছেন, সেহেতু শ্রমিকদের সঙ্গে তাঁরা রাজপথে আন্দোলনে থাকবেন।
রোববার শ্রীমঙ্গল উপজেলার বিভিন্ন চা-বাগান ঘুরে দেখা গেছে, অন্যান্য দিনের মতো শ্রমিকেরা সব চা-বাগানে একত্র হয়ে সভা-সমাবেশ করছেন না। তবে শ্রমিকেরা বাগানের কাজ বন্ধ রেখে বাসাবাড়িতেই আছেন। বেলা একটার দিকে উপজেলার কালিঘাট চা-বাগান থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শ্রমিকেরা। প্রায় আড়াই কিলোমিটার হেঁটে ফুলছড়া চা-বাগানের সড়কে অবস্থান নেন তাঁরা। এ সময় শ্রীমঙ্গল-কালিঘাট সড়কে প্রায় এক ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দাবি আদায়ে শ্রমিকদের বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে দেখা গেছে।
চা-শ্রমিক মিলন তাঁতী বলেন, গতকাল বিভাগীয় শ্রম দপ্তরে সরকারি কর্মকর্তা ও সংসদ সদস্যের পেছনে বোকার মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁদের নেতা। অসহায়ভাবে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। নেতাদের চাপ দিয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ শ্রমিকেরা সেটা মেনে নেননি। গত রাত থেকেই তাঁরা প্রতিবাদ করছেন। তাঁরা ১৪৫ টাকা মজুরির সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন।
পরিতোষ কুমার তাঁতী নামের আরেক শ্রমিক বলেন, ‘যদি ১২০ টাকার মজুরি ১৪৫ টাকা করা হয়, তাহলে আমরা কেন এত দিন ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছি। গতকাল বৈঠকে মাননীয় সংসদ সদস্য ছিলেন, তিনি জাতীয় সংসদে চা-শ্রমিকদের মজুরি ৫০০ টাকা করার দাবি জানিয়েছিলেন। গতকাল তিনি কী কারণে দাবি থেকে নেমে মাত্র ১৪৫ টাকা করার সিদ্ধান্ত শ্রমিকনেতাদের চাপিয়ে দিচ্ছিলেন। শ্রমিকেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চা-বাগানে কাজ করেন। তাঁদের সঙ্গে এ ধরনের নয়ছয় ঠিক না। যত দিন দাবি না মানা হবে, আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাব।’
রঞ্জিতা তাঁতী নামের এক নারী চা-শ্রমিক বলেন, পেটের ভাতের জন্য তাঁরা আন্দোলন করছেন। ১২০ টাকা দিয়ে কিছুই কেনা যায় না। তাঁদের দাবি, ৩০০ টাকা আর দালালেরা ১৪৫ টাকার কথা বলে। দালালেরা প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে আন্দোলন বন্ধ করতে চায়।
ধর্মঘটের অষ্টম দিনে গতকাল শনিবার মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় বিভাগীয় শ্রম দপ্তরে শ্রম অধিদপ্তর ও সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকে বসেন চা-শ্রমিকনেতারা। বৈঠক শেষে চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল ২৫ টাকা বাড়িয়ে মজুরি ১৪৫ টাকা করায় ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্বাসে ধর্মঘট স্থগিতের ঘোষণা দেন।
তবে ওই সিদ্ধান্ত মেনে নেননি সাধারণ চা-শ্রমিকেরা। তাঁরা সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে সিলেটসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। সাধারণ শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে চা-শ্রমিকনেতা নিপেন পালও সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। সাধারণ শ্রমিকদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।
রোববার চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বালিশিরা ভ্যালির সভাপতি বিজয় হাজরা প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল বৈঠকে বসে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের কথা শুনে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু সাধারণ শ্রমিকেরা তা মানেননি। শ্রমিকেরা তাঁদের নির্বাচিত করেছেন, তাঁদের সুখে-দুঃখে, আন্দোলন-সংগ্রামে অবশ্যই পাশে থাকবেন তাঁরা। আজ অনেক চা-বাগানে সভা-সমাবেশ বন্ধ আছে। আগামীকাল সব বাগানে একই সময়ে বৃহত্তর আন্দোলনে নামবেন তাঁরা। শ্রমিকদের জন্য যদি জীবন দিতে হয় বা জেল খাটতে হয়, তবু সেটা করবেন তাঁরা।