যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার ধলগ্রাম স্লুইসগেট এলাকায় চিত্রা নদীর পাড়ে দেখা মিলবে ছোট একটি দোকানের। সেখানে পাওয়া যায় শিঙাড়া-আলুচপসহ নানা তেলেভাজা। ১০ বছর ধরে এই দোকান করে সংসার চালাচ্ছেন রেহেনা বেগম নামের এক নারী।
ছোট্ট একটি চালার নিচে দাঁড়িয়ে রেহেনা বেগম ভেজে চলেছেন শিঙাড়া, আলুচপ, পেঁয়াজু, বেগুনি ও পাঁপড়। সেদ্ধ করছেন ছোলা। সেগুলো সাজিয়ে রাখছেন সামনের ছোট বাক্সের মধ্যে। হাটে-রাস্তায় লোকসমাগম যত বাড়তে থাকে, ব্যস্ততা ততই বাড়ে রেহেনার।
সরেজমিন দেখা যায়, বড় গ্রাম্য হাট ধলগ্রাম। ২০০ বছরের পুরোনো হাটটিতে দোকানপাট আছে ২৭৫ থেকে ২৮০টি। যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার ধলগ্রাম ইউনিয়নের ধলগ্রাম হাট বসে সপ্তাহে দুই দিন—শনি ও বুধবার। ভোরে হাট বসে, রাতে ভাঙে। হাট থেকে প্রায় ৪০০ মিটার দূরে ধলগ্রাম স্লুইসগেট এলাকা। এখানে চিত্রা নদীর পাড়ে টিনের ছাপরা। ঘরের সামনে মাটিতে রাখা ছোট কাঠের চৌকি। চৌকির ওপর পলিথিনের বস্তা বিছানো। তার ওপর এক পাশে কাচ দিয়ে ঘেরা কাঠের ছোট বাক্স। বাক্সের ওপর রাখা কিছু থালা, পিরিচ ও চামচ। ঘরের এক পাশে জ্বলছে মাটি দিয়ে তৈরি কাঠের চুলা। কড়াইতে তেলে ভাজা হচ্ছে শিঙাড়া, আলুচপ, পেঁয়াজু ও বেগুনি। সেগুলো প্রথমে রাখা হচ্ছে বাঁশের তৈরি চালুনিতে। এরপর সাজিয়ে রাখা হচ্ছে বাক্সের ভেতরে। বাক্সের মধ্যে অ্যালুমিনিয়ামের একটি গামলায় রয়েছে সেদ্ধ ছোলা। তার পাশে দোকানের চালায় পলিথিনে ঝুলছে কয়েক প্যাকেট পাঁপড়। পাশে রাখা আছে একটি বালতি এবং অ্যালুমিনিয়ামের কলস। কলসভরা পানি। পাশে পানিভর্তি কয়েকটি বোতল, কয়েকটি স্টিলের গ্লাস। তার পাশে দুটি বেঞ্চ। ক্রেতারা বেঞ্চে বসে শিঙাড়া খাচ্ছেন।
মঙ্গলবার দুপুরে দোকানে দাঁড়িয়ে শিঙাড়া ভাজছিলেন রেহেনা বেগম। কী পরিমাণ শিঙাড়া, আলুচপ ও বেগুনি তৈরি করেন, জানতে চাইলে রেহেনা বলেন, সপ্তাহে দুই হাটের দিন বাদে প্রতিদিন ১৫০টি শিঙাড়া, আড়াই কেজি আটার পেঁয়াজু, এক কেজি ছোলা, এক কেজি আলুচপ, একটি বড় বেগুনের (২০টি বেগুনি হয়) বেগুনি এবং আড়াই শ গ্রাম ওজনের পাঁপড় ভাজেন তিনি। আর হাটবারে ৪০০ শিঙাড়া, তিন কেজি আটার পেঁয়াজু, দেড় কেজি ছোলা, এক কেজি আলুচপ, একটি বড় বেগুনের (২০টি বেগুনি হয়) বেগুনি এবং আড়াই শ গ্রাম ওজনের পাঁপড়। শিঙাড়া, আলুচপ, পেঁয়াজু, বেগুনি প্রতিটি পাঁচ টাকা করে বিক্রি করেন। ছোলা ১০ টাকা প্লেট আর পাঁপড় প্রতিটি চার টাকা করে বিক্রি হয়।
রেহেনা বেগম বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল আটটায় দোকান খুলি। স্বামী আমার সঙ্গে দোকানে আসেন। দুজনে মিলে সব উপকরণ প্রস্তুত করি। এরপর উনি ভ্যান চালাতে চলে যান। প্রথমে ছোলা সেদ্ধ করি, এর পরপরই শিঙাড়া তৈরি করি। পর্যায়ক্রমে তৈরি করি পেঁয়াজু, বেগুনি ও আলুচপ। শেষে পাঁপড় ভাজি। চলে রাত আটটা পর্যন্ত। দোকান বন্ধ করতে করতে রাত নয়টা বেজে যায়। প্রায় ১০ বছর ধরে এসব বানাচ্ছি।’
রেহেনা বেগম জানান, সব খরচ বাদে হাটের দিন ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা এবং অন্য দিনে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা তাঁর আয় হয়। দোকানের ভাড়া দিতে হয় মাসে ৩০০ টাকা।
রেহেনা বেগমের বাড়ি যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার ধলগ্রাম গ্রামে। স্বামী মুরাদ হোসেন ফকির (৫২) ভ্যান চালান। তাঁদের দুই মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের কোনো জমি নেই। খাসজমিতে টিনের ঘর তুলে সেখানে বসবাস করেন।
রেহেনা বেগম আগে সরকারের কর্মসৃজন কর্মসূচিতে শ্রমিকের কাজ করতেন। সব সময় কাজ হতো না। সে সময় তিনি দিনমজুরের কাজ করতেন। তাতেও প্রতিদিন কাজ হতো না। ১০ বছর আগে তিনি শিঙাড়া, আলুচপের দোকান করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, ‘আটা, তেল ও আলুর দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু শিঙাড়া, আলুচপ ও বেগুনির দাম আগের মতো পাঁচ টাকাই আছে। সংসারে খরচ অনেক বেড়েছে। খুব কষ্ট করে চলতে হচ্ছে। অন্য কোনো কাজ করতে পারি না। কোনো উপায় নেই, তাই বাধ্য হয়ে এ কাজ করছি।’
রেহেনার দোকানের বসে শিঙাড়া খাচ্ছিলেন বাঘারপাড়া উপজেলার কবিরভিটা গ্রামের কৃষক আসিবুল সরদার (৬০)। তিনি বলেন, ‘১০ বছর ধরে প্রায়ই এখানে শিঙাড়া, আলুচপ খেতে আসি। নিরিবিলি জায়গা। রেহেনা শিঙাড়া, আলুচপ ভালো বানান। খেতে ভালোই লাগে।’