নীতিমালা উপেক্ষা করে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে সরকারের ক্ষতি ৫০ লাখ টাকার।
ভোলার ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে সাড়ে তিন কোটি টাকার ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জামসহ বিভিন্ন মাল সরবরাহের কাজ সর্বোচ্চ দরদাতাকে দেওয়া হচ্ছে। দরপত্র মূল্যায়নে অনিয়ম ও সরকারি ক্রয় নীতিমালা লঙ্ঘন করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই ঠিকাদারকে এই কাজ দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ওই দরপত্রে অংশ নেওয়া অন্য ঠিকাদারেরা।
কাজ না পাওয়া ঠিকাদারেরা অভিযোগ করে বলেন, সরকারি ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী সর্বনিম্ন ও দ্বিতীয় নিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে, সর্বোচ্চ দরদাতাকে সরবরাহের কাজ দেওয়া হয়েছে। এতে সরকার কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সুবিধা গ্রহণ করে নিজেদের ইচ্ছেমতো সর্বোচ্চ দরদাতাকে সরবরাহের কাজ দিয়েছে। দরপত্র মূল্যায়নে সময়ক্ষেপণ করেছে। তাঁরা আদালতে দরপত্র কমিটির বিরুদ্ধে মামলা করবেন। তবে দরপত্র কমিটির প্রধান, হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক দরপত্রে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
ভোলা জেনারেল হাসপাতাল কার্যালয়, দরপত্র বিজ্ঞপ্তি পর্যালোচনা ও ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১৩ নভেম্বর ভোলার স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় ভোলা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ছয়টি গ্রুপে ওষুধ, যন্ত্রপাতি, গজ-ব্যান্ডেজ, লিনেন, রাসায়নিক দ্রব্য ও আসবাব সরবরাহের দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। ওই দরপত্র আহ্বান করেন কমিটির প্রধান, হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মু. মনিরুল ইসলাম। ই-জিপির (ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট) মাধ্যমে আহ্বান করা দরপত্র বিক্রির শেষ তারিখ, দাখিল ও খোলার তারিখ ছিল গত ৩ ডিসেম্বর।
ঠিকাদারেরা জানান, নিয়ম অনুযায়ী ৬টি গ্রুপে (ই-জিপি টেন্ডারে) মোট ১১টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ওষুধ ও রাসায়নিক দ্রব্য ক্রয়ের দরপত্রে ৯টি এবং যন্ত্রপাতি, গজ-ব্যান্ডেজ, লিনেন ও আসবাব ক্রয়ের দরপত্রে ১১টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়।
দরপত্রে অংশ নেওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে আনিসা করপোরেশন, মেসার্স পিপলাই এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স মো. জাকির হোসাইন, মেসার্স বাপ্পী ইন্টারন্যাশনাল, জুয়াইরিয়া ইন্টারন্যাশনাল, মায়ের দোয়া এন্টারপ্রাইজ, ফরচুন করপোরেশন, মেসার্স আহসান ব্রাদার্স, মেসার্স এন এস ট্রেডার্স, এশিয়া ট্রেডিং ও জুবায়ের সার্জিক্যাল।
ঠিকাদারেরা জানান, ৩ ডিসেম্বর একই দিনে দরপত্র ক্রয়, দাখিল ও খোলার শেষ তারিখ রাখলেও মূল্যায়নে দরপত্র কমিটি সময় নিয়েছে ৫৪-৫৫ দিন। অর্থাৎ গত ২৬ জানুয়ারি কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে তা জানানো হয় এবং দুই দিনের মধ্যে ওই প্রতিষ্ঠানকে (সর্বোচ্চ দরদাতা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান) কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এমনকি তার কাছ থেকে প্রথম লটের মালামাল গ্রহণ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
সরকারি ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী, দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতার কাজ পাওয়ার কথা। কিন্তু এখানে দেখা গেছে, ছয়টি গ্রুপের কাজের মধ্যে সব কটিই সর্বোচ্চ দরদাতা ফরচুন করপোরেশন পেয়েছে।
ঠিকাদারদের অভিযোগ, দরপত্র কমিটি দরপত্র মূল্যায়নে অকৃতকার্য হওয়া দরদাতাদের জামানত ফেরত দেবে এবং কী কারণে তাদের অকৃতকার্য দেখানো হয়েছে, সেই কারণ ঠিকাদারদের জানাবে। এখানেও ক্রয় নীতিমালা উপেক্ষা করা হয়েছে। এখনো তাদের কাজ না পাওয়ার কারণ জানানো হয়নি।
দরপত্রপ্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া মেসার্স বাপ্পী ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক সোহাগ কৃষ্ণ জানান, তাঁরা ২৫ বছর ধরে ভোলা জেনারেল হাসপাতালে ওষুধসহ বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করে আসছেন। গত বছরও তারা নিয়ম অনুযায়ী দরপত্রে অংশগ্রহণ করে সুনামের সঙ্গে মালামাল সরবরাহ করেছেন। এবারও ই-জিপি দরপত্র অংশ নিয়েছেন এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী কাগজপত্র অনলাইনে জমা দিয়েছেন। ই-জিপি দরপত্রের নীতিমালা (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট)অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতাকে সরবরাহের কাজটি দেওয়ার কথা; কিন্তু তাদের দেওয়া হয়নি।
মেসার্স পিপলাই এন্টারপ্রাইজের পরিচালক সত্যকৃষ্ণ পিপলাই বলেন, দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা ছিলেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদেরও কাজটি দেওয়া হয়নি। কী কারণে সর্বনিম্ন দরদাতাদের সরবরাহের কাজটি দেওয়া হয়নি, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা–ও জানায়নি।
ঠিকাদারেরা জানান, কী কারণে অন্য ঠিকাদারদের বাদ দেওয়া হয়েছে, সেটি মৌখিক, চিঠিপত্র বা ই–মেইলে জানানো হয়নি। দরপত্র কমিটির কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তারাও কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। দরপত্র কমিটি ইচ্ছাকৃতভাবে অবৈধ সুযোগ নিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দিয়েছে।
ঠিকাদারেরা জানান, এ অনিয়মের পেছনে দরপত্র কমিটির প্রধান হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মু. মনিরুল ইসলাম, সদস্য হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) তায়্যেবুর রহমান ও জুনিয়র কনসালট্যান্ট, ইমতিয়াজ বেলালের যোগসাজশ রয়েছে। তাঁদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তাঁরা বলেন, এই দরপত্রপ্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছাড়া সবার দরপত্রে ভুল ছিল।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ভোলা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মু. মনিরুল ইসলাম বলেন, যে কাজ পান না, সে–ই অভিযোগ দেন। সর্বনিম্ন দরদাতার যদি কাগজপত্র ঠিক না থাকে, তাহলে কীভাবে তিনি প্রতিযোগিতায় আসেন, কীভাবে তিনি সরবরাহের কাজটি পাবেন? যাঁর কাগজপত্র সঠিক ছিল, তিনিই কাজটি পেয়েছেন।
তত্ত্বাবধায়ক আরও বলেন, ‘বিগত বছরে ম্যানুয়ালি দরপত্র আহ্বানের কার্যক্রম সম্পন্ন হতো। তখন প্রতিবছর একই ব্যক্তি ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের কাজ পেতেন। এবার ইজিপিতে দরপত্র আহ্বান করায় তিনি ঠিকভাবে কাগজপত্র জমা দিতে পারেননি। তাই বাদ পড়েছেন। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই। আমরা বিষয়টি লিখিতভাবে তাঁদের জানিয়ে দিইনি, তবে দেব। এতেও যদি তাঁরা সন্তুষ্ট না হন, তাহলে আমাদের ডিজি অফিসে অভিযোগ জানাবে। সেখানে যদি তাঁরা সন্তুষ্ট না হন, তাহলে আদালতে যেতে পারেন।’